Advertisement
২০ ডিসেম্বর ২০২৪

আমার সন্তান যেন থাকে ইন্ডিয়াতে

এ দেশে এসেও তিন বার ভাঙনে ভিটে হারিয়েছেন নিতাই। ভাঙতে, ভাঙতে এখনও গ্রামের নাম দুর্গাপুর। তবে নামের আগে একটা চর যোগ হয়েছে।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

গৌরব বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৪:১৫
Share: Save:

পদ্মাপাড়ের কাশবন মাথা দুলিয়ে ডাকছে, ‘আয়, আয়...’

ভরা পদ্মায় তিরতিরে শরতের মেঘ হাতছানি দিচ্ছে, ‘বেরিয়ে পড়...’

নিকোনো উঠোনে হিমভেজা শিউলি বলছে, ‘দেখা হবে...’

এ সব কিসের ইঙ্গিত!

চারপাশে পুজো-পুজো গন্ধ। প্রতি বছরের মতো মহালয়ার সকালে নিতাই মণ্ডলের ঘুম ভাঙিয়েছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। কিন্তু বৃদ্ধ নিতাইয়ের কেবলই কান্না পাচ্ছে। গলায় আটকে নোনতা দলা।

সেই একাত্তরে দেশ ছাড়ার সময় থেকেই নিতাইয়ের বুক ধড়ফড় করে। নিতাইরা থাকতেন রাজশাহীর দুর্গাপুরে। বাপ-কাকার সঙ্গে এ দেশে এসে যেখানে বসত গড়লেন সেই জায়গারও তাঁরা নাম দিলেন দুর্গাপুর। দেশে না থাকলেও নামটা তো সঙ্গে থেকে গেল! কিন্তু ভিটে হারানো যাঁদের ললাট-লিখন, তাঁদের কি আর স্থির থাকার জো আছে!

এ দেশে এসেও তিন বার ভাঙনে ভিটে হারিয়েছেন নিতাই। ভাঙতে, ভাঙতে এখনও গ্রামের নাম দুর্গাপুর। তবে নামের আগে একটা চর যোগ হয়েছে। ভাঙনের সময়েও তাঁর বুক ধড়ফড় করত। নিতাই জানে, এ আসলে নিটোল ভয়। গত কয়েক দিন ধরে ফের সেটা শুরু হয়েছে। গ্রাম ভাঙুক বা দেশ, ভয়টা তো আসলে ভিটে হারানোর।

আর সেই ভয় সংক্রমণের মতো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। পাড়ার মাচায়, চায়ের দোকানে একটাই আলোচনা—এনআরসি। আজ বিডিও অফিস, কাল ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে নিতাই ছেলেদের দৌড়ঝাঁপ করতে দেখছেন। এনআরসি-র ভয়ে ইতিমধ্যে বেশ কয়েক জন মারাও গিয়েছেন। নিতাইয়ের মনে বোধনের আগে তাই বিসর্জনের বিষাদ।

একই রকম বিষাদ নিয়ে বাড়িতে চুপ করে বসে আছেন চর দুর্গাপুরের গুরুপদ মণ্ডল, টলটলির ভক্তচরণ হালদারেরা। কেউ বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছেন ৩৮ বছর আগে, কারও কেটে গিয়েছে চল্লিশ বছর। ভক্তচরণ একটা পুঁটলিতে নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের উঠোনের মাটি। ভেবেছিলেন, মাটিটুকু থাক স্মৃতি হয়ে। কিন্তু আস্ত ভিটের সঙ্গেও পদ্মা সেটাও গিলে খেয়েছে। ম্লান হাসছেন ভক্তচরণ, ‘‘এক জন্মে আর কত বার দেশান্তরী হতে হবে? এক বার সব ছেড়ে এ দেশে এলাম! আবার সে ভাবেই ফিরে যেতে হবে?’’

নিতাই মণ্ডল চোখের জল মুছে জানতে চান, ‘‘কোনটা তা হলে আমার দেশ? জন্মভূমিতে ঠাঁই হল না। চলে এলাম ইন্ডিয়ায়। এখন শুনছি, কাগজপত্র ঠিকঠাক না থাকলে আবার ফিরে যেতে হবে বাংলাদেশে। আমরা বুড়ো হয়েছি। আজ আছি, কাল নেই। জেলে পাঠালেও যাব। কিন্তু আমাদের সন্তানে‌রা? ওরা তো এ দেশেই জন্মেছে। দেশ ছাড়ার যন্ত্রণা যেন ওদের সহ্য করতে না হয়। আমার সন্তান যেন ইন্ডিয়াতেই থাকতে পারে। জগজ্জননীর কাছে এটাই প্রার্থনা।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Karimpur River Erosion Padma NRC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy