প্রতীকী ছবি।
ঘরের টান। নাকি রুজি-রুটির মায়া।
আনলক ওয়ানের প্রথম পর্বের শেষে ফের এই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে নবগ্রামের ফারুক হোসেন, খানাকুলের প্রণব জানা, দিনহাটার ফিরদৌস আলি, হিঙ্গলগঞ্জের সৌমেন মণ্ডলেরা। ওঁরা পরিযায়ী শ্রমিক। কর্মস্থল দিল্লি, মুম্বই, পুণে, সুরত, তিরুঅনন্তপুরম। কেউ জরি বা সোনার কারিগর। কেউ হিরে কাটেন। অনেকে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন।
রোগ, অনাহারে মৃত্যু ও শেষ সম্বলটুকু হারানোর ভয়। এ সবই ভিন্ রাজ্য থেকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরেছে হরিশ্চন্দ্রপুরের উমা রায়, গোয়ালপোখরের রশিদ আলম ও করণদিঘির সুনির্মল দাসদের। যাঁরা খুব ‘ভাগ্যবান’, তাঁরা শ্রমিক স্পেশালে ঠাঁই পেয়েছেন। বাকিরা কখনও হেঁটে, কখনও লরির মাথায় চেপে ফিরেছেন।
সেই দুঃস্বপ্নের পথে ওঁরা কেউ ফিরতে না চাইলেও অনেককেই হয়তো ফিরতে হবে। যেমন এ ক’দিনেই আবার ফেরার তোড়জোড় শুরু করেছেন ফরাক্কার সোনার কারিগর সইদুল শেখ, নওদার নির্মাণ কর্মী জিয়ারুল হক মণ্ডল বা শালতোড়ার ইলেকট্রিক মিস্ত্রি প্রবীর দাস। নওদার বাসিন্দা জিয়ারুল হক মণ্ডল বলেন, “আমরা কেরলে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতাম। দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা রোজগার করতাম। জোগাড়ের কাজ করলেও ৩৫০ টাকা আয় ছিল। এখানে সে টাকা পাব কোথায়!’’
একই কথা শোনালেন ফরাক্কার সোনার কারিগর সইদুল শেখ, “ভিন্ রাজ্যে যে কাজটা করি, তা যদি রাজ্যে বসে করতাম, এর অর্ধেক আয়ও হত না। লকডাউন পুরোপুরি উঠে গেলে ফিরে যাব মুম্বই।”
আরও পড়ুন: এদিক ওদিক করলে বেরিয়ে যান: মমতা
কেন এই হাল? সত্যিই কি এ রাজ্যে কাজের দাম কম? জেমস অ্যান্ড জুয়েলারি এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের এক কর্তার দাবি, সোনার কাজের ক্ষেত্রে মজুরির ফারাক বিশেষ নেই। কিন্তু কাজের পরিমাণ ও নিশ্চয়তার ফারাক অবশ্যই আছে। গুজরাত, মহারাষ্ট্রে কাজের বরাত বেশি। তাই বছরভর হাতে কাজ থাকে। যা এ রাজ্যে পাওয়া কঠিন।
তবে করোনা আবহে এখন ভিন্ রাজ্যেও সোনা বা হিরে কাটার কাজ শুরু হয়নি। দেশের বাজার প্রায় বন্ধ। রফতানিও তলানিতে। শুরু হয়নি জরির কাজও। আনলক ওয়ানের আগেই নির্মাণ প্রকল্প ছাড় পেলেও কেরল বা কর্নাটকে পুরোদস্তুর কাজ শুরু হয়নি। তাই ফিরে গিয়েও কাজ পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে পরিযায়ীদের অনেকেই। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যে কাজের নিশ্চয়তা না থাকায় সেই ঝুঁকি নিতে হবে।
তবে রাজ্য সরকার চায়, যাঁরা ভিন্ রাজ্য থেকে ফিরেছেন, তাঁরা আর যেন বাইরে না যান। এখানেই তাঁদের কর্মসংস্থানের উপরে জোর দিতে চায় সরকার। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার মতে, ‘‘এই সঙ্কটের সময়ে অন্যান্য রাজ্যে শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। রাজ্যে ফিরে তাঁরা পরিস্থিতির তুলনামূলক বিচার করার সুযোগ পাবেন।’’
পরিস্থিতির চাপেই অর্থনীতি এখন বেহাল। রাতারাতি সকলের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা যে সম্ভব নয়, তা জানে রাজ্য প্রশাসন। তবে নবান্নের এক কর্তা বলছেন, ‘‘মাছ-ভাতের ব্যবস্থা হয়তো এখনই হবে না। কিন্তু ডাল-ভাত জোগাড় করেই সবাই মিলে খাওয়া যেতে পারে।’’ পরিবারের কাছে থাকলে শ্রমিকদের মানসিক চাপ কমবে এবং অন্য রাজ্যে থাকার তুলনায় এখানে খরচও কম হবে, এই যুক্তিতেই তাঁদের থেকে যাওয়ার বার্তা দিচ্ছে প্রশাসন।
মহারাষ্ট্রের পুণে থেকে মাসখানেক আগে মালদহের গ্রামে ফেরা সাইফুদ্দিন শেখ অবশ্য বলেন, ‘‘পুণেতে রাজমিস্ত্রির কাজ করে ৭০০ টাকা মজুরি মিলত। রোজ কাজ পেতাম। এখানে এসে ১৪ দিন কোয়রান্টিনে থাকার পরে বাড়িতে আছি। ১০০ দিনের কাজের জব কার্ড থাকলেও কাজ পাইনি এখনও।’’ গোয়ালপোখরের রশিদ আলম, করণদিঘির সুনির্মল দাসদের কথায়, ‘‘হেঁটে ফিরেছি। পায়ের ক্ষত এখনও সারেনি। ফিরে গিয়ে যে কাজ পাব, তার কি নিশ্চয়তা আছে? কিন্তু এখানে তো এখনও কাজ পেলাম না।’’
অনেকে অবশ্য ভিন্ রাজ্যে আর কিছুতেই ফিরবেন না। তোর্সার পাড় ধরে ভরদুপুরে হাঁক দিচ্ছিলেন এক যুবক। উত্তরপ্রদেশে একটি কারখানায় নিরাপত্তা রক্ষী ছিলেন। তিনি বলেন, “কোনও মতে বেঁচে গিয়েছি। আর যাব না। এখন মাস্ক-গ্লাভস বিক্রি করছি। পরে না হয় আর কিছু করব।”
মন্তেশ্বরের গোলাম শেখও সম্প্রতি মহারাষ্ট্র থেকে ফিরেছেন। তিনি বলেন, ‘‘চুড়ির নকশা তৈরির কাজ করতাম। লকডাউনে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কিছুটা ট্রাকে, কিছুটা হেঁটে যে ভাবে বাড়ি ফিরেছি, আর ভিন্ রাজ্যে কাজ করতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy