নন্দীগ্রামের সোনাচূড়ায় উপকূলীয় অরণ্য ধ্বংস হচ্ছে। নিজস্ব চিত্র
দু’ধরনের অরণ্য রয়েছে অবিভক্ত মেদিনীপুরে। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামে রয়েছে শাল গাছ অধ্যুষিত অন্য গাছের জঙ্গল। আর পূর্ব মেদিনীপুরের একাংশে রয়েছে উপকূলীয় অরণ্য। ফলে সমস্যার রকমফেরও রয়েছে।
সমস্যার অন্যতম হল, বনভূমিতে আগুন লাগানো। জঙ্গলমহলে ঝরা পাতায় আগুন ধরানোর প্রবণতা রয়েছে। আবার বন্যপ্রাণী শিকারের জন্য জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেন অনেকে। অনেকে জঙ্গলের শুকনো পাতা পুড়িয়ে ছাই করে জমির উর্বরতা বাড়াতে ব্যবহার করেন। হাতির পাল অন্যত্র পাঠাতে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেন অনেকে. পশ্চিম মেদিনীপুর ডিস্ট্রিক্ট বায়ো-ডায়ভারসিটি ম্যানেজমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান শ্যামপদ পাত্র বলেন, ‘‘জঙ্গলে আগুন লাগানোর ফলে নষ্ট হয় প্রাকৃতিক ভারসাম্য। এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে।’’ ঝাড়গ্রামের পরিবেশকর্মী সৌরভ মুদলি বা প্রাক্তন বনাধিকারিক সমীর মজুমদার, উভয়েই জঙ্গলের আগুন নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
আরাবাড়ি বনাঞ্চলের সমস্যাটা অন্য। এই বনাঞ্চল ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে। ফলে ডিজেল, পেট্রোল, গ্যাসচালিত গাড়ি দাঁড়ায়। ছড়ায় দূষণ। আবার রাতে গাড়িতে করে বনভূমিতেই আবর্জনা ফেলে দিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। আরাবাড়ি জঙ্গল লাগোয়া আটাবান্দা, চাঁদমুড়া, বড়মুড়া, ডুকি-সহ কয়েকটি গ্রাম রয়েছে। আটাবান্দা গ্রামের বাসিন্দা বীরেন টুডু বলেন, ‘‘জঙ্গলে আবর্জনা ফেলে দিয়ে যান অনেকে। চন্দ্রকোনা রোড ও তার আশেপাশের এলাকার দোকানবাজারের আবর্জনাও গাড়ি করে ফেলে দিয়ে যায়। এতে তো জঙ্গলের অবস্থা খারাপ হচ্ছে।’’
নিয়মিত এই ক্ষতি সহ্য করতে পারবে তো জঙ্গলমহল? আশা রাখছে বন দফতর। পশ্চিম মেদিনীপুরে বন সুরক্ষা কমিটি রয়েছে ৬২৫টি। আড়াবাড়ির রেঞ্জার মলয়কুমার ঘোষ বলেন, ‘‘এখন জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট অনেকটাই ভাল। এফপিসি কমিটির লভ্যাংশ ২৫ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ হয়েছে। সদস্যেরা গুরুত্ব দিয়েই বনভূমি দেখছেন। এই বনাঞ্চলে প্রায় ২৫ শতাংশ বনভূমি বেড়েছে।’’ পশ্চিম মেদিনীপুরে গত ন’বছরে বৃক্ষরোপণ হয়েছে ১৫,৩০০ হেক্টর জমিতে। আরাবাড়ি বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাপ-সহ বিভিন্ন প্রাণী নিয়মিত জঙ্গলে ছাড়া হয়। সম্প্রতি ১৫-১৬টি জলাশয় কাটা হয়েছে জঙ্গলে।
উপকূলীয় অরণ্য রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরে। পরিবেশকর্মীরা জানাচ্ছেন, দিঘার মোহনা এলাকায় ৮০-৯০ এর দশকেও প্রচুর ম্যানগ্রোভ অরণ্য ছিল। যাত্রানালার কাছেও ছিল। কিন্তু সে সবের বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। জেলিংহ্যামে কয়েক হাজার ম্যানগ্রোভ নদীগর্ভে চলে যায় বলে জানান বিট অফিসার নারায়ণ প্রামাণিক। পরিবেশকর্মীরা অবশ্য বড়সড় ম্যানগ্রোভ বিনাশ দেখেছেন নয়াচরে। কয়েক লক্ষ ম্যানগ্রোভ কেটে ভেড়ি করা হয়েছে। হলদিয়া বন্দরের প্রশাসনিক ভবনের ১০ তলার উপর থেকেই নয়াচরের সবুজ মন কাড়ত। এখন সেখানে ফিশারি-র পুকুর ছাড়া আর কিছু কার্যত দেখা যায় না। পরিবেশকর্মী সুপ্রিয় মান্না বললেন, ‘‘প্রাকৃতিক সম্পদ নয়াচরের ম্যানগ্রোভ। কিন্তু নজরদারির অভাবে ম্যানগ্রোভ কেটে মাছের ভেড়ি হচ্ছে। নয়াচর চোখের আড়ালে বলে আমরা এই ক্ষতি অনুমান করতে পারছি না।’’
যদিও পূর্বের বনভূমি কমে যাওয়ার বিষয়টি মানতে নারাজ বন দফতর। ম্যানগ্রোভ অরণ্য ধ্বংসের অভিযোগও তাদের মতে ঠিক নয়। ডিএফও অনুপম খান জানালেন, প্রকৃতির নিয়মেই ভাঙা-গড়া চলে। বন দফতর খেজুরির কাছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য তৈরি করেছে। নন্দীগ্রামের জেলিংহ্যাম প্রান্তে এই জাতীয় গাছ বেড়েছে। হলদি দ্বীপ, নয়াচর বা বালুঘাটায় ম্যানগ্রোভ নতুন করে দফতরের আশা জাগাচ্ছে। দিঘায় লাগানো হচ্ছে কেওড়া গাছ। তা মাটি ধরে রাখে। কিন্তু ধ্বংস তো হচ্ছে বন দফতরের তৈরি ম্যানগ্রোভ অরণ্যও। কাঁথির নিজ কসবা গ্রামের বালিয়াড়িতে বন দফতরের বেশ কিছু ম্যানগ্রোভ মারা গিয়েছে। বন দফতরের দাবি, শ্বাসমূলের উপরে বালি এসে পড়ায় প্রাকৃতিক নিয়মেই মরে যাচ্ছে গাছ।
পরিবেশকর্মীদের মতে, উন্নয়নের কর্মকাণ্ডে নষ্ট হচ্ছে ঝাউ গাছও। দিঘায় ঝাউ গাছ প্রায় দেখা যায় না। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপক আশিসকুমার পাল বলছেন, ‘‘সময়ের সঙ্গে সমুদ্রের জলস্ফীতির প্রভাব বোঝা যাবে। তাই কর্দম ভূমিতে ম্যানগ্রোভ এবং বালুভূমিতে স্থানীয় গাছ বাড়াতে হবে। জুনপুট উপকূলে পরীক্ষামূলক ভাবে ম্যানগ্রোভ অরণ্য তৈরি করে দেখা গিয়েছে, নদী মোহনায় এই গাছ লাগানো যেতে পারে। ম্যানগ্রোভ অরণ্য তৈরি করা যেতে পারে শৌলা, জলদা, যাত্রানালা এবং চম্পা নদীর কাদাজমিতে। তা হবে উপকূল রক্ষায় ভবিষ্যতের ঢাল।’’
তবে উপকূলীয় পরিবেশে যে উন্নতি হয়েছে, তার প্রমাণ হিসেবে কুমিরছানার উদাহরণ আনেন বনাধিকারিক অনুপম। সম্প্রতি জেলায় তিন জায়গায় নোনাজলের তিনটি কুমিরছানা ধরা পড়েছিল। বনাধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘উপকূলের পরিবেশ ভাল বলেই মা কুমির ডিম পাড়তে এসেছিল।’’ (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy