লোকসভা ভোটের প্রচারের সময় নরেন্দ্র মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে যে তিক্ততা তৈরি হয়েছিল, বিজেপি ক্ষমতায় আসার দু’মাসের মাথায় তা মেটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে তিনি দিল্লি আসবেন বলে জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রীরা তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এটাই সাধারণ দস্তুর। কংগ্রেস শাসিত মহারাষ্ট্রের পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ, অসমের তরুণ গগৈ বা মোদীর ঘোর বিরোধী নীতীশ কুমারের রাজ্য বিহারের জিতনরাম মাঝি প্রায় সব মুখ্যমন্ত্রীই এই দু’মাসে মোদীর সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন। ব্যতিক্রম মমতা। সেই দূরত্ব এ বার ঘুচতে চলেছে। প্রাথমিক ভাবে ঠিক ছিল রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অন্যতম ব্যক্তিগত সচিব প্রদ্যোৎ গুহের ছেলের বিয়েতে যোগ দিতে ৩ অগস্ট দিল্লি আসবেন মমতা। পরের দিনও রাজধানীতে থাকবেন তিনি। ওই দিনই মোদী-মমতা সাক্ষাৎ করানোর একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছিল।
কিন্তু এ দফায় সম্ভবত দিল্লি আসছেন না মমতা। তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, ওই দু’দিন মুখ্যমন্ত্রীর জেলা সফর রয়েছে। সেই সফর বাতিল না করার জন্য অনুরোধ এসেছে জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে। অগস্টের ১৭ তারিখ আবার সিঙ্গাপুর সফরে যাবেন মমতা। এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর তরফে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়কে জানানো হয়েছে, সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে মোদীর সঙ্গে দেখা করবেন তিনি। এটা ঠিক যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও সময় এখনও মুখ্যমন্ত্রী চাননি। তবে দেখা করতে যে তাঁর আপত্তি নেই সেই বার্তাটি পৌঁছে দিয়েছেন তিনি।
মোদীর সঙ্গে মমতার বৈঠক অবশ্য সময়ের অপেক্ষাই ছিল বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতাদের একাংশ। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ভোট প্রচারের তাপ-উত্তাপে যতই মোদীর কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে পোরার কথা বলুন মমতা, তিনি কিন্তু জ্যোতি বসুর মতো বিজেপি সরকারকে বয়কটের পথে হাঁটেননি। মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে নিজে না-গেলেও পাঠিয়েছিলেন অমিত মিত্র, মুকুল রায়কে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে বৈঠকও হয় অমিতবাবুর। অন্য মন্ত্রী, অফিসারদেরও মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দেন, দিল্লিতে এই সরকারের কোনও বৈঠক যেন বয়কট না করা হয়।
রাজ্যে বসে কেন্দ্রের তিন মন্ত্রী পীযূষ গয়াল, স্মৃতি ইরানি এবং ধর্মেন্দ্র প্রধানের সঙ্গে দেখা করেছেন মমতা নিজেও। তিন জনকেই তিনি বলেন, বিজেপি-তৃণমূল রাজনৈতিক বিবাদ যা-ই থাক, কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের সংঘাত তিনি চান না। মমতার কথায়, “ভোটের ফলের ভিত্তিতে নরেন্দ্র মোদী আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত মতপার্থক্য একই রকম আছে। সেখানে কোনও আপস নেই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কেন্দ্র-রাজ্য সাংবিধানিক সম্পর্ক সুষ্ঠু রাখার দায়িত্ব পালন করতে আমি দায়বদ্ধ।”
মমতা মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীকে বয়কট করাটা ভুল রাজনীতি। বামপন্থীদের মুখে দীর্ঘদিন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিমাতৃসুলভ আচরণের অভিযোগ শুনতে শুনতে রাজ্যের মানুষ বীতশ্রদ্ধ। ফলে গোড়া থেকেই কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়াটা তারা ভাল চোখে দেখবে না। তাই শুরুতে রাজ্যের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য কেন্দ্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরি। পরে যদি দেখা যায় কেন্দ্র রাজ্যকে বঞ্চনা করছে বা বিপাকে ফেলার চেষ্টা করছে, তখন প্রয়োজনে আক্রমণাত্মক রাজনৈতিক লাইন নেওয়া যেতেই পারে।
আর মোদী তো বরাবরই রাজ্যগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার পক্ষপাতী। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগেই আনন্দবাজারকে তিনি বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চান তিনি। রাজ্যের জন্য তাঁর কিছু পরিকল্পনাও রয়েছে। এখন কেন্দ্রের সাহায্য গ্রহণ করা হবে কি না, তা রাজ্য সরকারকেই ঠিক করতে হবে। মমতার সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমি যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব আলোচনায় বসতে চাই। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন স্তব্ধ হতে না-দেওয়ার দায়িত্বটা প্রধানমন্ত্রীরও।”
আগামী বছরের পুরভোট এবং তার পরের বছরের বিধানসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে রাজ্যে দলীয় সংগঠন সাজাতে উদ্যোগী বিজেপি সভাপতি অমিত শাহও এই সুসম্পর্কের সমর্থক। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। মহারাষ্ট্র বা অসমের মুখ্যমন্ত্রী যদি দেখা করেন, তা হলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীই বা করবেন না কেন?” কিন্তু তাই বলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপি যে তৃণমূলের প্রতি কোনও নরম মনোভাব নিচ্ছে না, তা-ও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। অমিত শাহের কথায়, “বিজেপি সভাপতি হিসেবে দলকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন করার চেষ্টা করাটাই তো আমার দায়িত্ব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার জায়গায় থাকলে সেটাই কি করতেন না!” বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ অবশ্য মমতার উদ্যোগের পিছনে অন্য গন্ধ পাচ্ছেন। তাঁর অভিযোগ, “সিবিআই এবং ইডি যে ভাবে সারদা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে নানা ধরনের আর্থিক অনিয়ম নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে, তাতে বিষম বিপদে পড়েছেন মমতা। পরিত্রাণের জন্য এখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হওয়ার চেষ্টা করছেন।”
সম্প্রতি তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য কে ডি সিংহের অফিস এবং বাড়িতে আয়কর তল্লাশি হয়। বিজেপি নেতারা বলছেন, এর পরই কে ডি সিংহ বিজেপির জাতীয় নেতাদের সাহায্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং মমতার সম্পর্ক স্থাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কে ডি নিজে অবশ্য আজ এই খবরের সত্যতা অস্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মমতার বৈঠকের বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই। রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা বিজেপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার কর্মসূচি তাঁর নেই।
তবে এটা ঠিক যে সারদা কেলেঙ্কারি বা কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরে পণ্য খালাসে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এখন তদন্ত করছে কেন্দ্রের বিভিন্ন সংস্থা। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে গিয়েছে। বন্দরের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে নিতিন গডকড়ীর মন্ত্রক। এই দুই ক্ষেত্রেই একাধিক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে।
রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অভিযোগ নিয়েও সক্রিয় হয়েছে কেন্দ্র। এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে বারবার রিপোর্ট চেয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। রাজ্যে একাধিক বার ঘুরেও গিয়েছে বিজেপির প্রতিনিধি দল। এতে মমতা ক্ষুব্ধ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের চিঠির জবাবও রাজ্য দেয়নি।
রাজ্যের ঘাড়ে চেপে বসা ঋণের বোঝা লাঘবের প্রশ্নে কেন্দ্রের ভূমিকাতেও মমতা খুশি নন। ইউপিএ সরকারের দুই অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং পি চিদম্বরমের মতো অরুণ জেটলিও বুঝিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যের দাবির যৌক্তিকতা নেই। বাজেট বিতর্কের জবাবি ভাষণে জেটলি বলেছেন, রাজ্যের ঋণের বিষয়টি চতুর্দশ অর্থ কমিশনই দেখবে। তাদের সুপারিশ মোতাবেকই কাজ হবে।
তবে যে হেতু রাজ্যের এই আর্থিক সঙ্কটের জন্য মমতা দায়ী নন, সে হেতু তাঁর প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের কিছুটা সহানভূতি রয়েছে। রাজনাথ সিংহ একটা সময় প্রকাশ্যেই রাজ্যের ঋণ মকুবের ব্যাপারে সওয়াল করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীও আনন্দবাজারকে বলেছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সঙ্কট কী ভাবে মেটানো যাবে তা নিয়ে আমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।” মমতা-মোদী বৈঠক হলে রাজ্যের কোষাগারের জন্য কোনও সুখবর আসে কি না, সেটাও দেখার।
কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে অবশ্য তৃণমূল সাংসদদের মধ্যে দু’টি মত রয়েছে। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুলতান আহমেদরা অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। কিন্তু সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বা ডেরেক ও’ব্রায়েনরা সুসম্পর্ক রাখার পক্ষপাতী। সম্প্রতি মোদীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কল্যাণ এবং সুলতান মমতার রোষের মুখে পড়েন। তার পর মোদীর সঙ্গে দেখা করে সেই তিক্ততা দূর করার চেষ্টা করেন কল্যাণ। ট্রাই (সংশোধনী) বিলের বিরোধিতা করেও সরে আসতে হয় সৌগত রায়কে। তৃণমূল ওই বিল সমর্থন করে।
তৃণমূল সংসদীয় সূত্র বলছে, বিরোধিতা ও সমন্বয়, এই দু’টিকে সুকৌশলে কাজে লাগাতে চাইছেন মমতা। তাঁর সঙ্গে ঠিক যেমনটি করছে বিজেপি। অর্থাৎ সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy