বেলেঘাটার নির্বাচনী সভায়। রবিবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।
ব্যবধান ৪৮ ঘণ্টার। কলকাতা পুরভোটে প্রচারের দ্বিতীয় দিনে নিজের ছবি বিক্রির হিসেব নিজেই পাল্টে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
শুক্রবার বড়বাজারের সত্যনারায়ণ পার্কে তাঁর প্রথম নির্বাচনী সভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ছবি বিক্রি করে ২ কোটি টাকার কিছু বেশি আয় হয়েছে। রবিবার বেলেঘাটায় নির্বাচনী প্রচারসভায় গিয়ে কিন্তু তিনি বললেন, ৩০০টি ছবি বিক্রি করে তাঁর আয় হয়েছে ৯ কোটি টাকা! এর আগে সিবিআইকে গত চার বছরের (২০১০-’১৪) যে হিসেব তৃণমূলের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল, দলনেত্রীর আঁকা ছবি বিক্রি করে আয় হয়েছিল প্রায় সাড়ে ছ’কোটি টাকা। স্বাভাবিক ভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি বিক্রি বাবদ আয়ের তিন রকম হিসেব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে রাজনীতিকদের মধ্যে।
সারদা কাণ্ডের তদন্তে মমতার আঁকা ছবির প্রসঙ্গটি বারেবারেই উঠেছে। সম্প্রতি সিবিআই নোটিসের জেরে বিষয়টি নিয়ে ফের শোরগোল ওঠায় রবিবার বড়বাজারের সত্যনারায়ণ পার্কের জনসভায় মুখ খোলেন মমতা। সেই সভায় তাঁর আঁকা ছবি বিক্রি করে কত টাকা আয় হয়েছে এবং সেই টাকা কোন খাতে ব্যবহার হয়েছে, তার খতিয়ানও দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। এ দিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ব্যতিক্রম শুধু হিসেবের অঙ্কে! এ দিন বেলেঘাটার সভায় মমতা বলেন, ‘‘তিনটে আঁচড় দেব, ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হবে! আমার ৩০০ ছবি ৯ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। ৬০০ ছবি আমি বিনা পয়সায় দিয়েছি।’’ এ দিন তৃণমূল নেত্রীর হিসেব অনুযায়ী, তাঁর প্রতিটি ছবি গড়ে ৩ লক্ষ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। তৃণমূল নেত্রীর আঁকা ছবির দাম নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন সিপিএম-সহ বিরোধী দলগুলির নেতারা। পুরভোটের মুখে সে কথা মাথায় রেখেই এ দিন মমতা বলেন, ‘‘ওরা বাজার জানে না। এক একটা ছবি ১৫ কোটি টাকায় বিক্রি হতে পারে!’’ তার পরেই বিরোধী এবং সমালোচকদের উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমার ছবি হাজার, কোটি টাকায় বিক্রি করব! তোমার কী? তোমার পিতা, পিতামহ, তোমার বউয়ের কী?’’
মমতার আঁকা ছবি বিক্রির টাকা নিয়ে তৃণমূলের তরফে ইতিমধ্যেই সিবিআইয়ের কাছে হিসেব দেওয়া হয়েছে। তার পরে বড়বাজারের সভায় মমতা অন্য রকম হিসেব দেওয়ায় যথেষ্ট বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। এ দিন বেলেঘাটায় মমতা নতুন হিসেব দেওয়ায় বিতর্ক চরমে উঠেছে।
কেন তিনি এ দিন নতুন করে হিসেব দিলেন, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিরোধীদের বক্তব্য, নিজের আঁকা ছবি বিক্রির টাকা নিয়ে আজ এক রকম, কাল এক রকম কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী প্রমাণ করছেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে চাপে আছেন। বিশেষ করে পুরভোটের আগে নাগরিক সমাজের সামনে এই প্রসঙ্গটি দলের সমস্যা বাড়াতে পারে। সেই বিড়ম্বনা এড়াতেই তৃণমূল নেত্রী এ ভাবে প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন। মমতা নিজেও এ দিন এ কথাই বলেছেন। বেলেঘাটার সভায় তাঁর মন্তব্য, ‘‘আপনারা (বিরোধীরা) উল্টোপাল্টা বলছিলেন বলে জনতাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি।’’ এই প্রসঙ্গেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘জ্ঞানত কোনও অপরাধ করিনি। করলে মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই।’’
যদিও এ কথায় এড়ানো যায়নি হিসেব নিয়ে বিপত্তি! সিপিএমের এক নেতার রসিকতা, ‘‘বরং উনি মুখ না খুললেই ভাল হতো!’’ তৃণমূলের অন্দরেও নেতৃত্বের একাংশ মনে করেন, ছবি বিক্রি করে পাওয়া টাকা নিয়ে এক এক বার এক এক রকম হিসেব স্বয়ং দলনেত্রী না দিলেই পারতেন! এর ফলে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে।
এ দিন বিজেপি তথা কেন্দ্রকেও আক্রমণ করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর দফতর হচ্ছে সিবিআই। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া সিবিআই কিছু করে না। ইডি, আয়কর দফতরও কেন্দ্রের হাতে। তাদের দিয়ে তৃণমূলকে বিরক্ত করানো হয় ভোটের আগে। এটা বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের সময়ও হয়েছিল। কারণ, ওরা (বিজেপি) রাজনৈতিক লড়াই করতে পারছে না।’’
ছবি আঁকা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে স্বাভাবিক ভাবেই ছেড়ে কথা বলেননি বিরোধীরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র কালই বলেছিলেন, ‘‘উনি কখন কী বলেন, তার ঠিক নেই। আজ এক বলেছেন। কাল আর এক বলবেন। তার পরে আবার কখন কী বলবেন, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে!’’ সেই মন্তব্যের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই নিজের আঁকা ছবির দাম নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন নতুন হিসেব দিয়েছেন। যা নিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর কথায় আজকাল খুব হাস্যরসের উদ্রেক হচ্ছে! এটা ভাল লক্ষণ। তবে দু’দিনে যখন ছবি বিক্রির হিসেব ২ কোটি থেকে ৯ কোটিতে পৌঁছেছে, আর ক’দিন পরে কোথায় যায় সেটা দেখতে হবে!’’ সুজনবাবুর আরও কটাক্ষ, ‘‘ক্লাস সিক্স-সেভেনের ছেলেমেয়েরাও আজকাল ভাল ছবি আঁকে। তারা যখন শুনছে, মুখ্যমন্ত্রীর এক একটা আঁচড়ের দাম ১৫ লক্ষ টাকা, তখন তারাও বুঝছে এটা শিল্পের দাম নয়! মুখ্যমন্ত্রীর স্পর্শের দাম! তুলির আঁচড়ে তোলাবাজি আর কাকে বলে?’’
কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের মন্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর ছবি বিক্রি থেকে আয়ের অঙ্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে! শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে, চিট ফান্ড থেকে তৃণমূল কয়েক হাজার কোটি টাকা পেয়েছে এবং তার পুরোটাই মুখ্যমন্ত্রী নিজের ছবি বিক্রির আয় বলে চালাচ্ছেন!’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যও বলেন, ‘‘তৃণমূল নেত্রীর ছবির দামের ওঠা-পড়া ভারতীয় শেয়ার বাজারের হর্ষদ মেটার যুগকে মনে পড়িয়ে দিচ্ছে!’’
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিরোধীদের সমালোচনাকে তিনি গুরুত্ব দেন না। তাঁর কথায়, ‘‘ওদের কোনও কাজ নেই বলেই আমাকে গালমন্দ করে।’’ বিরোধীদের উদ্দেশে তাঁর পাল্টা তোপ, ‘‘আপনারা আমাকে কি ভাবেন? ভূত না প্রেত? আমি রাক্ষসী না ডাইনি?’’ একই সঙ্গে নিজের অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার কথা মনে করিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এদের এত বড় সাহস আমাকে চোর বলে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy