তিনি মুখ্যমন্ত্রী, তিনি দলনেত্রী। তিনি বই লেখেন, তিনি ছবি আঁকেন। বাংলার ছাত্রছাত্রীদের সামনে এ বার তিনি ডেল কার্নেগি অবতারেও।
আত্মোন্নতির সহজ পাঠ লিখে মার্কিন শিক্ষাবিদ ডেল কার্নেগি দীর্ঘ সময় পৃথিবী জুড়ে ‘বেস্ট সেলার’-এর তালিকায় ছিলেন। বৃহস্পতিবার টাউন হলে সেরা ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেন কার্নেগির ভূমিকাই নিলেন। পড়ুয়াদের জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার শিক্ষা দিতে গিয়ে নিজের জীবন আর নিজের বাণী একাকার করে দিলেন।
বললেন, ‘‘আমার জীবনটাই সংগ্রামে ভরা। তাও কখনও হেরে যাইনি, ভয় পাইনি, মাথা উঁচু করে থেকেছি। সার্ভিস উইথ স্মাইল। নিজেকে পজিটিভ হতে হবে।’’
বললেন, ‘‘যারা কাজ করতে পারে না...তারাই নেগেটিভ পাবলিসিটি করে। এটা তাদের জীবনে হতাশার লক্ষণ। এর থেকে যাতে তোমরা মুক্ত থাকো, তার জন্য আমি তোমাদের নিজের লেখা বই দিয়েছি।’’
হ্যাঁ, এ বছর থেকেই সেরা পড়ুয়াদের জন্য পুরস্কারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মমতার লেখা বই। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের সঙ্গে মমতার ‘কথাঞ্জলি’। আগের দিন মাদ্রাসার সেরা ছাত্রছাত্রীদের হাতেও তুলে দেওয়া হয়েছিল বইয়ের এই সম্ভার। এ দিন মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক-আইসিএসই-আইএসসি-তে মেধাতালিকায় প্রথম দশে থাকা ছাত্রছাত্রীদের জন্যও একই উপহার। সঙ্গে বাড়তি পাওনা মমতার আরও একটি, ‘বেস্ট অব মমতা’। মুখ্যমন্ত্রীর নিজেরই দাবি, ‘‘বইয়ে আমার ‘কোট’গুলিতে চোখ বোলালে জীবন অনেক সহজ হয়ে যাবে।’’ তাঁর বই ‘নিয়মিত পড়লে ইতিবাচক মনোভাব’ও গড়ে উঠবে।
কী লেখা আছে এই সব বইয়ে? মমতার টুকরো টুকরো বাণী। হতাশ হতে নেই, লোভ করতে নেই, অহঙ্কার ভাল নয়, স্বাস্থ্যই সম্পদ, ‘কুল’ থাকো— এই সব। এগুলো কবে থেকে মমতার নিজস্ব রচনা হল, সে প্রশ্ন অবশ্য নিন্দুকেরা তুলছেন। মমতার লেখা বই কোন যুক্তিতে পড়ুয়াদের হাতে তুলে দেওয়া হল, কারা এই সিদ্ধান্ত নিলেন, উঠছে সেই প্রশ্নও। শিক্ষাবিদরা অনেকেই এ সব দেখে হতভম্ব। তবে প্রশাসনের অন্দরের খবর, মুখ্যমন্ত্রী কারও কথার ধার ধারেননি। তিনি চেয়েছেন, তাই তাঁর বই দেওয়া হয়েছে। এ দিনের বক্তৃতায় মমতা বলেও দেন যে, তিনি নিজে বইগুলি কিনে এনেছেন! এর আগে এক বার প্রশাসনিক বৈঠকে তাঁকে দাওয়াই দিতে শোনা গিয়েছিল, মানসিক চাপ কাটাতে আঁকিবুঁকি কাটা খুব ভাল উপায়! সেই পরামর্শ তাঁর বইতেও ঠাঁই পেয়েছে। তার সঙ্গে মা-মাটি-মানুষের কথা, সংবাদমাধ্যমের সমালোচনাও আছে। সবচেয়ে বেশি আছে— হতাশা কাটানো আর সমালোচনায় কান না দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্পের কথা।
কখনও লিখছেন, ‘‘নেভার মাইন্ড ফর ব্যাকবাইটিং।’’ কখনও বলছেন, ‘‘সব রোগের ওষুধ আবিষ্কার হলেও হিংসা রোগের কোনও ওষুধ নেই।’’ সোজাসাপ্টা পরামর্শ দিচ্ছেন, ‘‘যখন সব সেট হয়ে গেছে, তখন আর আপসেট হয়ো না। এনভায়রনমেন্ট পলিউশন থেকেও মেন্টাল পলিউশন বেশি ক্ষতি করে।’’
সাদা জমিতে ফ্লুরোসেন্ট হলুদ পাড় দেওয়া তাঁতের শাড়ি আর হাওয়াই চপ্পল পরা মুখ্যমন্ত্রী মাইক হাতে নিয়ে এ দিন ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন নিজের জীবনের গল্প বলে। বলেছেন, ‘‘চোট খেয়ে এগোতে গিয়ে যে সব আমার কাজে লেগেছে, সে সবই বইয়ে লেখা।’’ বারবার বোঝাতে চেয়েছেন তিনি ছাত্রছাত্রীদের উন্নতির কথাই ভাবছেন, সব সময় তাদের পাশে আছেন। কেউ যেন নিজের অসুবিধার কথা সরাসরি তাঁকে জানাতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে। নিজের বাড়িতে হোক বা নবান্ন, এমনকী কনভয়ে জেলা সফরের সময়ে গাড়ি থামিয়েও তাঁকে সমস্যার কথা বলা যেতে পারে। বলেছেন, ‘‘আমার বাড়ির অফিস তো সকাল সাড়ে দশটা থেকেই খুলে যায়। তা ছাড়া আমি যখন গাড়িতে যাই, তখন রাস্তাতেও অনেকে বলেন। ‘হেজিটেট’ করবে না। আমাদের দায়িত্ব তোমাদের দেখা।’’
মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনতে-শুনতে কিশোরদের এক দল উৎসুক চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল বইয়ের পাতায়। সঙ্গে ফিসফাস আলোচনা— ‘‘এই দ্যাখ লেখা আছে, ‘জীবন-জীবনী-জীবন গ্রন্থে জীবন জীবনাঞ্জলি শতক চলে, আবার আসে নূতন শতাঞ্জলি!’ এর মানে কী রে?’’ পাশের জন বলে ওঠে, ‘‘আরে এটা পড়ে দ্যাখ! ‘উন্নত চরিত্র, সভ্যতার সা-রে-গা-মা-পা’! কিছু বোঝা গেল?’’ বোঝা তো পরের কথা, এ সব পড়লে ছাত্রছাত্রীদের মাথা গুলিয়ে যেতে পারে বলে কিন্তু আশঙ্কা করছেন বিরোধীরা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর কথায়, ‘‘ওঁর নিজের মাথা তো খারাপই ছিল। এখন ছেলেমেয়েদের মাথা খারাপ করার
কল করছেন!’’ আর বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যর কটাক্ষ, ‘‘উনি তো নিজেকে মহাপুরুষ ভাবছেন! নিজের মতো করে নতুন কথামৃত লিখছেন!’’
কিন্তু নিজেকে মহান মনে করা কি অসঙ্গত? মনোবিদদের মতে, মনে করাটা যদি পরিমিত পরিমাণে হয় তা হলে সেটা আত্মিক উন্নতিতে সাহায্য করতে পারে। বৃহতের সাধনা, বৃহতের অনুকরণ জীবনে প্রেরণা দিতে পারে। কিন্তু নিজেকে বৃহৎ ভাবার প্রবণতা যদি মাত্রাতিরিক্ত হয়, তখন তা স্বাভাবিক নয়। আর বিরোধীদের একাংশের টীপ্পনী, মমতা যে ভাবে নিজের লেখা বই বিলোচ্ছেন, প্রায় মনীষীদের মতো বাণী দিচ্ছেন, কখনও শিক্ষাগুরু কখনও বা মনোবিদের ভূমিকা নিচ্ছেন— এটা খুব মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় নয়।
তবে এ সব কথায় মমতা নিজে অবশ্য কোনও দিনই কান দেন না। এগুলোকে ক্ষুদ্র মনের ঈর্ষা এবং কুৎসা বলেই মনে করেন। কুৎসা ও অপপ্রচার দুর্বলতার লক্ষণ, বইয়ে লিখেছেন তিনি। এ দিন ছাত্রছাত্রীদেরও বলছিলেন, ‘‘... রাস্তায় চলতে গেলে কখনও পিচের মসৃণ রাস্তা আসবে আবার কখনও রাস্তায় এলোমেলো গর্ত থাকবে। তাই বলে হাঁটা থেমে থাকবে না।’’ এই হাঁটা জীবনের পথে হাঁটাও বটে, আবার শরীর চর্চার হাঁটাও বটে। মমতা নিজে রোজ ১৫ কিলোমিটার হাঁটেন। বলছিলেন, যখন বেরোতে পারেন না, তখন ঘরের মধ্যে পায়চারি করেন আর মোবাইলে ‘অ্যাপস’-এর সাহায্যে কতটা পায়চারি করলে ১৫ কিলোমিটার হয় সেটা হিসেব করে নেন। রসিকতা করে তাঁর মন্তব্য, ‘‘মোবাইলে চার্জ দিতে-দিতে তো আমি নিজেই চার্জার হয়ে গিয়েছি।’’ মোবাইল ছাড়া থাকতে পারেন না। ফোনে কথা বলতে-বলতে রাতে খেতেও ভুলে যান মাঝে মাঝে, নিজেই বললেন গল্প করে। বললেন, ‘‘হয়তো রাতে ঘুমিয়েছি। মাঝরাতের পর এমন একটা মেসেজ এল যে ঘুম-টুম ছুটে গেল।... আবার সারাদিন কোনও মেসেজ না-এলে মনে হবে, ধুর! কোনও মেসেজ এল না!’’
তবে তাতেই বা কী? বি কুল অলওয়েজ, মমতার জীবনমন্ত্র!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy