মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
লোকসভা ভোটের আগে ক্রমশই দলের রাশ নিজের হাতে নিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্প্রতি বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনের অবসরে বিধানসভা ভবনে মমতার নিজের ঘরে বিভিন্ন জেলা সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক ও সাক্ষাতের পর সেই ইঙ্গিত মিলেছিল। তার পরে বিভিন্ন জেলার নেতৃত্বকে ডেকে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী বৈঠক করে দলের ‘দিশা’ ঠিক করা শুরু করেছেন।
বুধবার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে সে কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা। তিনি যা বলেছেন, তা থেকে স্পষ্ট, লোকসভা ভোটের আগে তিনি দলে কোনও অনৈক্য বা পরস্পরবিরোধী বিবৃতির লড়াই দেখতে বা শুনতে চাইছেন না। ওই বৈঠকে কড়া বার্তাও দিয়েছেন তিনি। এর পরে শুক্রবার মুর্শিদাবাদ জেলার তৃণমূলের শীর্ষনেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসবেন মমতা। তার পরে ধাপে ধাপে সব জেলা সংগঠনকে কালীঘাটের বাসভবনে এসে দলনেত্রীর আহূত বৈঠকে যোগ দিতে হবে। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, কয়েক মাস আগে পর্যন্ত তৃণমূলের ব্লক, জেলা তথা রাজ্য নেতাদের বৈঠকের জন্য তলব করা হত ক্যামাক স্ট্রিটে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতরে। যা তৃণমূল নেতাদের কাছে ‘এবি’-র (অভিষেককে এই নামেই ডাকেন অধিকাংশ তৃণমূল নেতা) অফিস বলেই পরিচিত। কিন্তু সেই নেতাদের অভিমুখ আবার কালীঘাটমুখী হতে শুরু করেছে। দলের নেতাদের একাংশের মতে, ‘‘এই জেলাওয়াড়ি বৈঠকগুলোর বার্তা একটাই— দলের প্রার্থিতালিকাটা মোটামুটি ঠিক করে দেওয়া।’’
দলীয় সংগঠনে মমতার ‘সক্রিয়তা’ যে বাড়তে চলেছে, তা স্পষ্ট হয়েছিল গত ২৩ নভেম্বর নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে আয়োজিত তৃণমূলের কর্মিসভায়। সেই বৈঠকে যোগ দেননি অভিষেক। কয়েক মিনিটের জন্য ভার্চুয়াল এবং খানিকটা ঔপচারিক উপস্থিতি ছিল তাঁর। যা কারও নজর এড়ায়নি। যদিও দলের রাজ্য সভাপতি তথা মমতা স্বয়ং জানিয়েছিলেন, চোখের সমস্যার কারণে অভিষেককে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। তাই তিনি ওই বৈঠকে সশরীরে উপস্থিত হতে পারেননি। সেই বৈঠকে দলনেত্রী মমতা নবীন-প্রবীণ নিয়ে পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন দমদমের সাংসদ সৌগত রায়ের কথা উল্লেখ করে। যা অভিষেকের ‘বয়সনীতি’র পরিপন্থী বলে দলেরই অনেকে মেনে নিয়েছিলেন। তার পরেও অভিষেক নবীন-প্রবীণ বিতর্কে মুখ খুলেছেন। যদিও সব সময়েই তিনি বলেছেন, দলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা। তিনি যেমন বলবেন, সেই পথেই দল চলবে। কিন্তু অভিষেক শিবিরের বিভিন্ন নেতা বিবিধ বিবৃতি দিতে থাকেন। তাতে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে।
তৃণমূলের একটি অংশের দাবি, দলের শীর্ষ স্তরে নীতির সংঘাত গত অক্টোবরে রাজভবনের সামনের ধর্না তুলে নেওয়া নিয়ে। অভিষেক চেয়েছিলেন ধর্না চালিয়ে যেতে। কিন্তু শারদোৎসব-সহ উৎসবের মরসুমের কথা মাথায় রেখে সেই ধর্না তুলে নিতে নির্দেশ দেন অভিজ্ঞ রাজনীতিক মমতা। অবস্থান তুলে নেওয়ার সময়ে অভিষেক মঞ্চ থেকে ঘোষণাও করেন, ‘‘আমি এই ধর্না পুজোর সময়েও চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে অবস্থান তুলে নিচ্ছি। তবে ১ নভেম্বর থেকে আবার আমাদের আন্দোলন শুরু হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখেই দিল্লির বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন সঙ্ঘবদ্ধ করব।’’
কিন্তু ১ নভেম্বর ঘোষিত আন্দোলন সে ভাবে হয়নি। তখন থেকেই অভিষেক খানিকটা দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেন। কেন তাঁর ওই অবস্থান, ঘনিষ্ঠদের কাছে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অভিষেকের আস্থাভাজন এক নেতা বলেছিলেন, ‘‘ব্যাপারটা ওঁর খারাপ লেগেছে! নবজোয়ার যাত্রায় যে ভাবে উনি সাড়া পেয়েছিলেন, তার রাজনৈতিক লাভটাও সে ভাবে আর ধরে রাখা যায়নি। সেটাও খারাপ লাগার আরও একটা কারণ।’’
ফলে দলের দৈনন্দিন কাজকর্মের সঙ্গে ‘দূরত্ব’ একটা ছিলই। তার উপর ২০২৩ সালের একেবারে শেষে অভিষেকের সঙ্গে তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ নেতাদের বৈঠকের পরে এই খবরও ছড়িয়ে পড়ে যে, দলের সেনাপতি বলেছেন, তিনি নিজেকে নিজের লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান। যা নিয়ে নতুন করে দলের অন্দরে জটিলতা তৈরি হয়েছে। তবে বুধবার মমতার বাড়িতে দলীয় বৈঠকে অভিষেক যোগ দেওয়ায় ‘শৈত্য’ আপাতত খানিকটা হলেও কেটেছে বলে দলের একাংশের আশা। কিন্তু তাঁরাও অদূর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছেন। এই প্রশ্ন নিয়ে যে, লোকসভা ভোটে অভিষেকের ‘ভূমিকা’ কী হয়। প্রসঙ্গত, বুধবারের বৈঠকে অভিষেক বক্তৃতা করতে চাননি। মমতার অনুরোধে তিনি বলতে রাজি হন। তাঁর নেতৃত্বে ‘নবজোয়ার’ যাত্রার প্রসঙ্গও তোলেন তিনি। তবে বৈঠকে হাজির এক নেতার কথায়, ‘‘মমতাদি থাকলে আমাদের কাছে বাকি সব গৌণ। বক্সী (তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী) আর অভিষেক বক্তৃতা করেছেন। তবে সকলে দিদির কথাই মন দিয়ে শুনেছি। সেটাই আমাদের কাছে দলের নির্দেশ।’’
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পরে অভিষেককে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে নিযুক্ত করেছিলেন মমতা। তখন থেকেই নতুন করে দলের সংগঠন গুছিয়ে তোলার কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। সঙ্গে দলের জন্য বেশ কিছু ‘সংস্কারমূলক’ নীতিও কার্যকর করার কথা ঘোষণা করেছিলেন অভিষেক। যার অন্যতম ছিল দলে ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতি কার্যকর করা। পাশাপাশিই প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন, প্রবীণ নেতাদের একটি নির্দিষ্ট বয়ঃসীমার পরে (তাঁর মতে ৬৫ বছর) ভোটে দাঁড়ানো থেকে সরে আসা উচিত। তখন থেকে দলীয় সংগঠন অভিষেকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন মমতা। বিধানসভা ভোটের পর থেকেই অন্য চেহারায় ধরা দেয় তৃণমূল। দলের ‘অভিষেকপন্থী’ নেতারা দলের সেই কাঠামোকে ‘নতুন তৃণমূল’ বলে দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে হোডিং লাগিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছিলেন।
অভিষেকের ‘সংস্কারনীতি’ প্রথম ধাক্কা খায় কলকাতার পুর নির্বাচনে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার পুরভোটে নিজের নীতি কার্যকর করতে চেয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। পুরভোটে টিকিট বণ্টন নিয়ে আলোচনায় মমতার সঙ্গে তৃণমূলের শীর্ষনেতাদের পাশাপাশি হাজির ছিলেন অভিষেক ও তৃণমূলের পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোর। সেই বৈঠকে টিকিট বণ্টন নিয়ে রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী ও তৎকালীন মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জোর বিবাদ হয় আইপ্যাক কর্তা প্রতীক জৈনের। শেষ পর্যন্ত মমতার হস্তক্ষেপে অভিষেকের ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ ও ‘বয়ঃসীমা’র নীতি দূরে সরিয়ে পাঁচ জয়ী বিধায়ক, এক সাংসদ ও বহু প্রবীণ নেতাকে টিকিট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মন থেকে না মানতে পারলেও দলনেত্রীর সিদ্ধান্ত মেনে নেন অভিষেক।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্যের অন্যত্র পুরসভা ভোটেও প্রার্থিতালিকা নিয়ে দলের অন্দরে বিতর্ক বেধেছিল। সেই সময়েও বহু আসনে প্রার্থী বদল করতে হয় শেষ মূহূর্তে। তবে সেই পরিস্থিতিও সামাল দিয়ে সংগঠনের হাল ধরেছিলেন অভিষেক।
কিন্তু লোকসভা ভোটের আগেই আবার অভিষেক সরব হয়েছেন বয়ঃসীমার নীতি নিয়ে। সম্প্রতি নিজের লোকসভা কেন্দ্রের এক কর্মসূচিতেও অভিষেক বলেছেন, ‘‘আজ আমি যতটা কাজ করতে পারছি, ৫৬ বছর হলে সেই কাজ করতে পারব? ৭০ হলে কি পারব?’’
অভিষেকের ওই বক্তব্যের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গঙ্গাসাগরের সরকারি মঞ্চ থেকে প্রবীণ দুই আমলা (দু’জনেই প্রাক্তন মুখ্যসচিব) আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে দেখিয়ে মমতা বলেন, ‘‘যোগ্যতা থাকলে ৬০ বছর হয়ে গেলেই আমরা তাঁদের বিদায় দিই না। আমরা অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাই।’’ তৃণমূলের অন্দরের বিশ্লেষণ, লোকসভা ভোটে নেত্রী হিসেবে দলের প্রবীণ নেতাদের ফেলে দেবেন না। ফলে উত্তর কলকাতায় সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, দমদমে সৌগত রায়, শ্রীরামপুরে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো বর্ষীয়ান তৃণমূল সাংসদদের টিকিট পাওয়া প্রায় নিশ্চিত।
যেমন বুধবারের বৈঠকে অভিষেকের উপস্থিতিতেই মমতা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ঘাটালে তিনি অভিনেতা দেবকেই চাইছেন। সেই সূত্রে মিমি চক্রবর্তী, নুসরত জাহানরাও টিকিট পাবেন বলেই মনে করছে দলের একাংশ। অথচ, ভোটে ঝেঁটিয়ে সেলুলয়েডের তারকাদের প্রার্থী করার বিষয়ে অভিষেকের যে আপত্তি রয়েছে, তা দলের অন্দরে সকলেই জানেন। তিনি চান, ভোটে যাঁদের প্রার্থী করা হবে, তাঁরা ‘সর্বক্ষণের রাজনীতিক’ হবেন। লোকসভার প্রার্থী তালিকায় মমতা না অভিষেক— কার ‘ছায়া’ থাকে, তা নিয়েও দলের অন্দরে জল্পনা শুরু হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ডায়মন্ড হারবারের কর্মসূচিতে অভিষেক প্রকাশ্যেও জানিয়ে দিয়েছেন, লোকসভা ভোটে তিনি নিজেকে ডায়মন্ড হারবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান। দল তাঁকে কোনও কর্মসূচি দিলে তিনি অবশ্যই সেখানে যাবেন। কিন্তু ওই একই সময়ে তাঁর লোকসভা কেন্দ্রে কোনও কর্মসূচি থাকলে ডায়মন্ড হারবারই ‘অগ্রাধিকার’ পাবে। ইতিমধ্যে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিয়েছেন ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ। লোকসভা ভোটের আগে দলীয় সংগঠনের রাশ যখন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন মমতা, তখন নিজের মতো করেই ডায়মন্ড হারবারে কর্মসূচি নিতে শুরু করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। নিজের কেন্দ্রে নিজ উদ্যোগে বার্ধক্যভাতা দেওয়ার পরে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ ২৪ পরগনার আমতলায় নিজের লোকসভা কেন্দ্রের প্রশাসনিক বৈঠক ডেকেছেন অভিষেক। এখন দেখার, লোকসভা ভোটে ডায়মন্ড হারবারের ‘লক্ষ্মণরেখা’ তিনি অতিক্রম করেন কি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy