ফাইল ছবি
সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া তৃণমূলে সমস্ত জাতীয় স্তরের শীর্ষপদের আপাতত অবলুপ্তি ঘটানো হল। অবলুপ্তি ঘটালেন স্বয়ং মমতাই! বদলে গড়া হয়েছে ২০ জনের জাতীয় কর্মসমিতি। যারা দলের কাজ দেখাশোনা করবে। কর্মসমিতির মাথায় রয়েছেন মমতা নিজে।
তৃণমূলের অন্দরের ব্যাখ্যা, এই পদক্ষেপের মমতা আরও একবার দলের অন্দরে নিজের অবিসংবাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। বস্তুত, সূত্রের দাবি, বৈঠকে উপস্থিতি নেতারা সকলেই মমতার হাতে দলের দায়িত্ব পরিপূর্ণ ভাবে অর্পণ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, ‘মমতাই দলে শেষ কথা’। নেতাদের সাক্ষর সংবলিত সেই বার্তাও দলনেত্রীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সূত্রের আরও দাবি, বৈঠকে সকলের সামনেই মমতা ‘ঐক্যবদ্ধ’ হয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে এই কোনও খবরই প্রকাশ্যে কোনও নেতা বলেননি। পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং ফিরহাদ হাকিম শুধু জাতীয় কর্মসমিতির সদস্যদের নামের তালিকা বৈঠকের শেষে পড়ে দিয়েছেন। ঘটনাচক্রে এই তালিকায় নাম নেই তৃণমূলের দুই সাংসদ সৌগত রায় এবং ডেরেক ও’ব্রায়েনের। এই দু’জনেই অভিষেকের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে দলের অন্দরে পরিচিত।
দলের জাতীয় স্তরের সমস্ত পদের অবলুপ্তির কথা শনিবার কালীঘাটে মমতার ডাকা দলের বৈঠকের পর জানিয়ে দিয়েছেন পার্থ। পার্থ অবশ্য সরাসরি ‘শীর্ষপদের অবলুপ্তি’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেননি। তিনি বলেছেন, ‘‘জাতীয় কর্মসিমিতি ঘোষিত হল। এর পর পদাধিকারীদের নাম নেত্রী ঘোষণা করবেন।’’
যার অর্থ, পার্থ নিজে যেমন দলের মহাসচিব থাকলেন না (যদিও পার্থের ঘনিষ্ঠদের দাবি, তিনি বঙ্গ তৃণমূলের মহাসচিব পদে রয়েছেন), তেমনই দলের সভাপতি থাকলেন না সুব্রত বক্সি। আবার একই ভাবে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক থাকলেন না অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তবে অভিষেককে অন্যদের সঙ্গেই জাতীয় কর্মসমিতিতে রাখা হয়েছে। কাকে কোন পদ দেওয়া হবে, তা পরে স্থির করবেন মমতা স্বয়ং। সেই কর্মসমিতি এবং পদাধিকারীদের নাম যথাসময়ে নির্বাচন কমিশনে জানানো হবে।
পার্থের কথায়, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী হওয়ার পর চার-পাঁচ জনের নাম বলেছিলেন। বলেছিলেন, তাঁরা আপাতত কাজ চালাবেন। তাঁদের উনি ডেকেছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের জাতীয় কর্মসমিতির সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হল। পদাখিরারী যাঁরা হবেন, সে তালিকা তিনি অতি শীঘ্রই মনোনীত করবেন। এবং তা জাতীয় নির্বাচন কমিশনে জানিয়ে দেওয়া হবে।’’
কেন এমন পদক্ষেপ করলেন মমতা?
তৃণমূলের একাধিক নেতার ব্যাখ্যা, দলের অন্দরে ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ নীতি নিয়ে যে বিরোধ এবং বিতর্ক চলছিল, তার জেরে অভিষেক তাঁর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিতে পারেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠেরা ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। সেই কারণেই মমতা এক ধাক্কায় সমস্ত পদের অবলুপ্তি ঘটালেন। অর্থাৎ, কারও পদই যদি না থাকে, তা হলে তিনি পদত্যাগ করবেন কী করে!
যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে এই ব্যাখ্যার কথা স্বীকার করেননি কেউই। তবে তৃণমূল সূত্রের খবর, মমতা কারও সঙ্গেই কোনো আলোচনা করে বা মতামত চেয়ে ওই কর্মসমিতি ঘোষণা করেননি। একেবারেই মমতার নিজস্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর্মসমিতি ঘোষণা করা হয়েছে।
শনিবারের ঘোষণার ফলে অভিষেক যেমন আর দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রইলেন না, তেমনই তিনি জাতীয় কর্মসমিতিরও সদস্য রইলেন। অর্থাৎ, দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক কমিটির একজন সদস্য হয়ে রইলেন তিনি। এর পর তাঁকে মমতা কোনও পদ দেন কি না, তা দেখার। দিলেও অভিষেক কোন পদে থাকেন, সেটিও দেখার।
মোট আট জন ছিলেন শনিবারের বৈঠকে। মমতার সম্প্রতি তৈরি করে দেওয়া কোর কমিটির সদস্যেরা তো ছিলেনই। তাঁদের সঙ্গেই ডাকা হয়েছিল দলের প্রবীণ সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। ঘটনাচক্রে, এঁদের মধ্যে মন্ত্রী চন্দ্রিমা ছাড়া প্রত্যেকেই মমতার ‘আস্থাভাজন’ এবং বহু যুদ্ধের সঙ্গী।
বিতর্ক শুরু হয়েছিল মূলত অভিষেকের প্রণীত ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ নীতি নিয়ে। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হওয়ার পর অভিষেক দলের অন্দরে ওই নীতি প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন। সেই মতো কিছু কিছু পদক্ষেপও করা হয়েছিল। তার প্রথম ব্যত্যয় ঘটে কলকাতার পুরভোটের আগে মেয়র এবং মন্ত্রী ফিরহাদের ক্ষেত্রে। ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ নীতির উল্টোপথে গিয়েই ফিরহাদকে পুরভোটের টিকিট দেওয়া হয়। তখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে দলের অন্দরে জলঘোলা হতে শুরু করেছে।
সেটি চরমে ওঠে রাজ্যের ১০৮টি পুরসভার ভোটের জন্য দলের প্রার্থিতালিকা নিয়ে। দু’টি ভিন্ন তালিকা প্রকাশ পায়। কথিত, তার মধ্যে একটি তৈরি করেছিল প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা আইপ্যাক। অন্যটি করেছিলেন পার্থ-বক্সীরা। দুই তালিকা নিয়ে বিভ্রান্তির সঙ্গে সঙ্ঘাতও শুরু হয়। মমতা স্পষ্টতই বলে দেন, পার্থ-বক্সীর তৈরি করা তালিকাই চূড়ান্ত। পক্ষান্তরে, আইপ্যাকের তালিকা বলে পরিচিত তালিকাটি প্রকাশ করা হয় তৃণমূলের ফেসবুক এবং টুইটারে (যে তালিকা এখনও নামিয়ে নেওয়া হয়নি)।
তবে ওই কোনও বিষয় নিয়েই শনিবারের বৈঠকে আলোচনা হয়নি। যেমন আলোচনা হয়নি আইপ্যাক বা প্রশান্ত কিশোর নিয়েও। অভিষেক বৈঠকে প্রায় মৌনীই ছিলেন। দলের নতুন বাড়ি নির্মাণে বিলম্ব হচ্ছে বলে তিনি বৈঠকে মতপ্রকাশ করেন। বৈঠকে উপস্থিত ফিরহাদকে মমতা বিষয়টি দেখার নির্দেশ দেন।
প্রসঙ্গত, অভিষেক গোয়ায় বিধানসভা ভোটের বিষয়টি দেখভাল করছেন। আগামী সোমবার সেখানে ভোট। মমতা গোয়ার ভোটের প্রসঙ্গে বলেন, তৃণমূল গোয়ায় চার থেকে পাঁচটি আসনে ভাল লড়াই করবে। মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টিও দু-তিনটি আসনে ভাল লড়াই করবে বলে দাবি করছে। তার পরেই মমতা জাতীয় কর্মসমিতির সদস্যদের নাম জানিয়ে দেন। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতার কথায়, ‘‘এতদিনে ওয়ার্কিং কমিটি গঠন সম্পূর্ণ হল। নেতাজি ইন্ডোরে নেত্রী যে চার-পাঁচ জনের নাম বলেছিলেন, এতদিন তাঁরাই কাজ চালাচ্ছিলেন। এ বার পূর্ণাঙ্গ কমিটি হল।’’
ঘটনাচক্রে, বৈঠকের পর পার্থ প্রথম বেরিয়ে যে তালিকাটি ঘোষণা করেন, তাতে ২০ জনের নাম ছিল না। ফিরহাদ পরে বেরিয়ে পূর্ণাঙ্গ তালিকাটি ঘোষণা করেন। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, পার্থের পঠিত তালিকায় অভিষেকের নাম তিন বা চার নম্বরে ছিল। ফিরহাদের পঠিত তালিকায় অভিষেকের নাম ছিল দু’নম্বরে। মমতার পরেই। সূত্রের খবর, এই বৈঠকের পর প্রায় এক ঘণ্টা একান্তে বৈঠক করেন মমতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy