Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Bangla Pokkho

Bengali Language: ‘সাথে’ না ‘সঙ্গে’, ব্যানার শহরে, বাঙালি বলছে, গরব-আশা-বাংলাভাষা

ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের মতে, ‘সাথে’ কথাটি পূর্ব বাংলায় বহুল প্রচলিত। কিন্তু আগে কলকাতার মানুষ ওই শব্দটি সেই অর্থে ভাষায় ব্যবহার করতেন না।

‘সঙ্গে’ বলুন সাথে নয় — এই মর্মে একটি ব্যানার পড়ল কলকাতার সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে।

‘সঙ্গে’ বলুন সাথে নয় — এই মর্মে একটি ব্যানার পড়ল কলকাতার সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে। নিজস্ব চিত্র

ভাস্কর মান্না
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২১ ১৮:৪০
Share: Save:

‘সঙ্গে’ বলুন ‘সাথে’ নয়। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে এই মর্মে একটি ব্যানার নজর কেড়েছে কলকাতার অনেক নাগরিকের। কারা লাগিয়েছেন ওই ব্যানার? মঙ্গলবার দিনভর চক্কর কেটেও তা খুঁজে বার করা যায়নি। তবে বাঙালি মনীষা খানিক আশ্বস্ত হয়েছে— এ বার বাঙালির আশা আছে। এখনও সব কিছু ফুরিয়ে যায়নি। অন্য ভাষার আগ্রাসন এবং প্রভাব থেকে (যেখানে ‘জারি’ বা ‘চালু’র বদলে ‘লাগু’ ব্যবহৃত হচ্ছে অনায়াসে) এখনও বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার অবকাশ রয়েছে।

পাঁচ ফুট বাই দু’ফুট সেই ব্যানারে অফ হোয়াইটের উপর খয়েরি রঙে লেখা দু’টি লাইন— ‘সঙ্গে’ বলুন সাথে নয়/ সাথের ব্যবহার শুধু গানে ও কবিতায়। তার নীচে একটু ছোট হরফে, ‘আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়/ রামকৃষ্ণ মিশন, গোলপার্ক বক্তৃতায়’।

অর্থাৎ, এই বাক্য আচার্য সুনীতিকুমারের। এবং তিনি তা বলেছিলেন, গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারে দেওয়া একটি বক্তৃতায়। লাইনগুলি স্পষ্ট পড়া গেলেও জানা যাচ্ছে না, কে বা কারা ওই ব্যানার টাঙিয়েছেন! আর তা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা। বাংলা ভাষার ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে এই সচেতনতা কাদের উদ্যোগে? তবে কি বাঙালি মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রে এবং তার শুদ্ধ প্রয়োগরীতি নিয়ে সচেতন হতে চাইছে?

প্রসঙ্গত, ভাষাবিদরাও দীর্ঘ দিন ধরেই ‘সাথে’ নয়, ‘সঙ্গে’ লেখার পক্ষপাতী। তাঁদের মতে, ‘সাথে’ কথাটি পশ্চিমবাংলার ভাষায় নয়। সেটি এসেছে পূর্ববঙ্গ থেকে। অর্থাৎ, শেখ হাসিনা ‘সাথে’ বলতে পারেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সঙ্গে’ বলবেন। ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের মতে, ‘সাথে’ কথাটি পূর্ব বাংলায় বহুল প্রচলিত। কিন্তু আগে পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতার মানুষ ওই শব্দটি সেই অর্থে ভাষায় ব্যবহার করতেন না। কারণ, তখনকার মান্য চলিত বাংলায় ‘সাথে’ চলত না। কিন্তু সারা পূর্ববঙ্গের (এখন বাংলাদেশ) ভাষা অঞ্চলে ‘সাথে’ কথাটি ‘সঙ্গে’ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পবিত্রের কথায়, ‘‘পরে যখন বিভিন্ন সময়ে প্রচুর মানুষ ওপার বাংলা থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসেন, তখন তাঁদের মুখে মুখেই ধীরে ধীরে ‘সঙ্গে’র পরিবর্তে ‘সাথে’ শব্দটি বিস্তার লাভ করে। তার ফলেই এখানকার বাঙালির মধ্যে কথাটি প্রচলিত হয়ে যায়। এখন কথাটির প্রয়োগ টেলিভিশন, সিনেমা ও সাহিত্যেও লক্ষ্য করা যায়।’’ তবে সে সময় ‘সাথে’ শব্দটি নিয়ে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আপত্তি করেছিলেন, সে কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন পবিত্র। তাঁর কথায়, ‘‘পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে ‘সাথে’ শব্দটি পশ্চিমের প্রমিত বাংলায় ঢুকে পড়েছে। এখন সব জায়গায় ব্যবহার হচ্ছে। তবে সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাথে’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি করেছিলেন।’’

অধুনা প্রয়াত নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘বাংলা কী লিখবেন, কেন লিখবেন’ বইয়েও লিখেছেন, ‘সাথে লিখবেন না। পদ্যেও আজকাল বড় কাউকে সাথে লিখতে দেখা যায় না, গদ্যে তো একেবারেই অচল।’ সেই সুর শোনা গেল বাংলা ভাষার গবেষক বারিদবরণ ঘোষের গলায়। তিনি বললেন, ‘‘সহিত থেকে কাব্যিক প্রয়োগে সাথে কথাটি এসেছে। কিন্তু গদ্যে কাব্যিক প্রয়োগ মানানসই নয়। আবার যে হেতু আমরা গদ্যের ভাষায় কথা বলি, তাই বলার সময় সাথে কথাটি না বলাই ভাল। তবে লঘু অর্থে এর প্রয়োগ করা যেতে পারে।’’ পবিত্রের অবশ্য অভিমত, ‘সাথে’র ব্যবহার যে ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে তাকে আটকানো কঠিন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভাষা বিজ্ঞানের দিক থেকে বলি, লোকের মুখে যেটা এসে যায়, সেটাই শেষ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই ‘সাথে’ শব্দটিকে এখন আর বঞ্চিত বলতে পারব না। এটা চলবে, একে আটকানো যাবে না।’’

বিভিন্ন অভিধানে ‘সাথে’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। সেখানেও অব্যয় পদ হিসাবে দেখানো ‘সাথে’র পাশে ‘গ্রাম্য এবং আঞ্চলিক’ লেখা থাকে। শুধু তা-ই নয়, অভিধানে ‘সাথে’র সঙ্গে ‘কাব্যে ব্যবহৃত’ বলেও উল্লেখ করা হয়। সমার্থক শব্দ হিসাবে সেখানে দেওয়া থাকে ‘সঙ্গে’ এবং ‘সহিত’। তবে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষে ‘সাথে’ শব্দের কোনও উল্লেখ নেই। বাংলাদেশ সরকার সে দেশে ‘সরকারি কাজে প্রমিত বাংলা ব্যবহারের নিয়ম’ শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করেছে ২০১৭ সালে। সেখানে স্পষ্ট লেখা রয়েছে, ‘সাথে কথ্য এবং কাব্যিক বা সাহিত্যিক রূপ। প্রমিত রূপ ‘সঙ্গে’। আনুষ্ঠানিক বা দাপ্তরিক ব্যবহারে ‘সঙ্গে’ লেখাই সমীচীন।’

‘সাথে’ বনাম ‘সঙ্গে’র এই বিতর্কে আপাতত মজেছে বাঙালি। কৌতূহল এ নিয়েও যে, উৎসবের এই মরসুমে এত সুচারু ভাবে কে বা কারা মাতৃভাষার এই শুদ্ধতার প্রচারে মন দিল! দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা অসীম রায় যেমন বলছেন, ‘‘খবরের কাগজ বা টেলিভিশনে ‘সাথে’ তেমন ভাবে চোখে পড়েনি কখনও। কিন্তু সিরিয়ালে বা সাহিত্যে ‘সাথে’র ব্যবহার আকছার হয়। কয়েক দিন ধরেই এই ব্যানারটি এখানে দেখে কৌতূহল হচ্ছে, কারা এমন প্রচার করছে! চার দিকে তো শুধু রাজনৈতিক আর বিজ্ঞাপনী ব্যানার দেখেই আমরা অভ্যস্ত। তবে এই ব্যানার যদি বাংলা ভাষার শুদ্ধতায় সদর্থক ভূমিকার কারণে টাঙানো হয়ে থাকে, তবে তা সাধুবাদযোগ্য।’’

ব্যানারে রামকৃষ্ণ মিশন গোলপার্কের উল্লেখ থাকলেও তাঁরা যে সেটি টাঙাননি, তা স্পষ্ট জানিয়েছেন রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানে এখন পুজোর ছুটি চলছে। খুলবে আগামী বৃহস্পতিবার। প্রসঙ্গত, এ রাজ্যে ‘বাংলা’র পক্ষে একাধিক বার চড়া সুরে আন্দোলনরত সংগঠন ‘বাংলা পক্ষ’ সংগঠনের কর্ণধার গর্গ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আমরা ভাষার পক্ষে নই। আমরা জাতির পক্ষে। কোথাও বাংলা ভাষা মুছে ফেলার চেষ্টা হলে আমরা সরব হব। ওই ব্যানার আমাদের টাঙানোর কোনও প্রশ্নই নেই।’’ এ শহরেই বিজ্ঞাপন এবং তার ভাষা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন শৌভিক মিশ্র। তাঁর কথায়, ‘‘এই ধরনের লাইন আমরা টিজার অ্যাডভারটাইজমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। অনেক সময় জন পরিষেবামূলক বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও আমরা এমন লিখে থাকি। কিন্তু বাংলা ব্যাকরণ বা ভাষা শেখানোর জন্য কেউ বিজ্ঞাপন করছে, এমন দেখিনি কখনও। শুনিওনি। ফলে এই ব্যানারের সঙ্গে বিজ্ঞাপনী কোনও বার্তা আছে বলে প্রাথমিক ভাবে আমার অন্তত মনে হচ্ছে না। যদি টিজার অ্যাডভারটাইজমেন্ট হয়, তা হলে পরবর্তী ব্যানারের জন্য অপেক্ষা করা উচিত।’’

অপেক্ষা না হয় করবে বাঙালি। কিন্তু দিদি কি এ বার ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ডের নাম বদলে ‘স্বাস্থ্যসঙ্গী’ করবেন!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE