সব ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া থাকে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রেও তত্ত্বটা বুঝি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হল!
জেলাশাসক বা পুলিশ সুপারদের থেকে ঠিকঠাক রিপোর্ট আসছিল না আগেই। এখন প্রিসাইডিং অফিসারেরাও কমিশনকে রিপোর্ট দিতে গড়িমসি করছেন! যা দেখে প্রশাসনের একাংশের ধারণা, প্রথা ভেঙে সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়ের মতো বিসিএস অফিসারকে কমিশনের মাথায় বসিয়ে রাজ্য সরকার যে ভাবে পদটির অবনমন ঘটিয়েছে, তার পরে এটা কার্যত প্রত্যাশিতই ছিল। ‘‘বলতে গেলে কমিশন সম্পর্কে রাজ্য সরকারের শীর্ষ মহলের মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন বিভিন্ন স্তরের সরকারি অফিসারেরা।’’— মন্তব্য নবান্নের এক আমলার।
সুশান্তবাবু যাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন, সেই মীরা পাণ্ডে পর্যন্ত মুখ্যসচিব বা অতিরিক্ত মুখ্যসচিব পদমর্যাদার আইএএস অফিসারদেরই রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত ডব্লিউবিসিএস সুশান্তবাবুকে ওই পদে বসিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার দীর্ঘ কালের রীতি ভাঙে। ভোটের সময়ে এক জন ডব্লিউবিসিএস অফিসার স্বরাষ্ট্র-সচিব, ডিজি বা পুলিশ কমিশনারের মতো তাবড় আইএএস-আইপিএসদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন কি না, প্রশ্নটা তখনই উঠেছিল। কেউ কেউ পরিষ্কারই সংশয় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘‘আইএএস-আইপিএসরা ওঁর কথা শুনবেন তো?’’
কার্যক্ষেত্রে সেই আশঙ্কারই বাস্তবায়ন হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল মনে করছে। যেমন রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার ডব্লিউবিসিএস হওয়ায় আইএএস-আইপিএসরা তাঁকে আমল দিচ্ছেন না। তাই ডিএম-এসপি’দের থেকে রিপোর্ট আসছে না।
অশোকবাবুর কথায়, ‘‘কমিশনকে নিষ্ক্রিয় করার বীজ বাম আমলেই পোঁতা হয়েছিল। এখন তা মহীরুহ।’’
এবং বড়কর্তাদের দেখাদেখি পুরভোটে প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে নিযুক্ত নিচুতলার আধিকারিকেরাও কমিশনের প্রতি উপেক্ষার মনোভাব নিয়েছেন বলে প্রশাসনের একাংশের অভিমত। এই মহলের বক্তব্য: রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি সরকারের উপেক্ষামূলক মনোভাবের সূত্রপাত মীরা পাণ্ডের আমলেই। ২০১৩-য় মীরাদেবী রাজ্য নির্বাচন কমিশনার থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে সরকার অসহযোগিতা শুরু করে। সংঘাতের জল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। শেষে রাজ্যকে হার মানতে হয়।
প্রশাসনের একাধিক সূত্রের দাবি, সেই ‘তিক্ত’ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই মীরাদেবীর অবসরের পরে তাঁর চেয়ারে সুশান্তবাবুকে এনে
বসায় নবান্ন।
সরকারের শীর্ষ মহলের ধারণা ছিল, শাসকদলের অনুগত লোককে কমিশনার করলে কমিশনের উপরে সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। কলকাতা পুরভোটে কমিশনের ভূমিকা দেখে বিরোধীপক্ষ তো বটেই, প্রশাসনিক কর্তাদের অনেকেও একান্তে বলছেন যে, সরকারের পরিকল্পনা সার্থক হয়েছে। ‘‘সুশান্তবাবু কার্যত সরকারের প্রতি তাঁর ঋণ শোধ করছেন।’’— কটাক্ষ এক আধিকারিকের।
তবে পশ্চিমবঙ্গে যে রাজ্য নির্বাচন কমিশনই একমাত্র ‘অথর্ব’ প্রতিষ্ঠান, তা নয়। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন কিংবা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের উপরেও সরকারের কর্তৃত্ব পুরোদস্তুর কায়েম হয়েছে। ফলে ওই সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে বলে অভিযোগ।
প্রবীণ আইএএস মীরাদেবীর সময়ে যেমন রাজ্যের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংঘাত দেখা দিয়েছিল, তেমন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান থাকাকালীন ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মমতা সরকার দ্বন্দ্বে জড়ায়। মানবাধিকার কমিশনের একাধিক সুপারিশ অগ্রাহ্য করা হয়। যেমন, ব্যঙ্গচিত্র-কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে ক্ষতিপূরণের সুপারিশ। রাজ্য সরকার তা না-মানায় অম্বিকেশবাবু কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন, যার ভিত্তিতে বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত ক্ষতিপূরণের নির্দেশ জারি করেন। সম্প্রতি সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে রাজ্য সরকার হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে গিয়েছে।
বিধি মোতাবেক, রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হতে পারেন সুপ্রিম কোর্টের কোনও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কিংবা হাইকোর্টের কোনও প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি। ঘটনা হল, অশোকবাবু মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদ ছাড়ার পরে তাঁর জায়গায় এমন কাউকে কিন্তু আনা হয়নি।
বরং কমিশনের দায়িত্ব ‘সামলানোর’ ভার দেওয়া হয়েছে রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে, যিনি
কিনা শাসকদলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে সম্যক পরিচিত। অভিযোগ, এমন লোককে এই দায়িত্ব দিয়ে রাজ্য সরকার আখেরে মানবাধিকার কমিশনকেই ঠুঁটো করে রেখেছে।
বস্তুত রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের একাধিক সূত্রেও এই আক্ষেপ প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আগে রাজ্যে বড় কোনও ঘটনা ঘটলে কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নিত। এখন শুধু রিপোর্ট তলব করে, আর তাতেই সক্রিয়তার ইতি। রিপোর্টের ভিত্তিতে তেমন কড়া সুপারিশ বা পদক্ষেপ আর দেখা যায় না।
পাশাপাশি রাজ্য সরকারি বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগের দায়িত্ব যার, সেই পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) ঘিরেও বিতর্কের বন্যা। অভিযোগ, মর্যাদাপূর্ণ এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মেও সরকারি প্রভাব ঘোরতর ছায়া ফেলেছে। কিছু দিন আগে ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগের জেরে পিএসসি-র চেয়ারম্যান পদে ইস্তফা দেন আইএএস অফিসার নুরুল হক। তাঁর জায়গায় নিয়োগ করা হয়েছে সইদুল ইসলামকে, যিনি পদোন্নতির সুবাদে (প্রোমোটি) আইএএস। এতে কার্যত পিএসসি’র গুরুত্বহানি হয়েছে বলে অনেকের অভিমত।
পিএসসি’তে নতুন চেয়ারম্যান আসার পরেও অবশ্য বিতর্কে ছেদ পড়েনি। বরং লিগ্যাল সার্ভিস পরীক্ষায় অনিয়মের নতুন অভিযোগ উঠেছে। রাজ্য মহিলা কমিশনের হালও তথৈবচ। ধর্ষণ-শ্লীলতাহানির মতো অপরাধ বাড়লেও কমিশনের তৎপরতা বিশেষ নজরে পড়ছে না। অনেকেই বলছেন, নারীনিগ্রহের বিভিন্ন ঘটনায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে ‘তুচ্ছ ব্যাপার’-এর তকমা লাগাচ্ছেন, মহিলা কমিশনের আচরণে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
‘‘রাজ্য মহিলা কমিশনেও তো এখন মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর দলের ঘনিষ্ঠদেরই প্রতিপত্তি!’’— মন্তব্য এক আমলার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy