দুর্নীতির টাকার পাহাড়। ফাইল চিত্র।
বছরটি এ বার কেমন কাটল?
বন্ধুদের আড্ডায় আলোচনা উঠতেই এক বয়স্য বললেন, ‘‘প্রশ্নটা বড় ক্লিশে! কিছু ভাল, কিছু মন্দ তো সব সময়ই থাকে। তা বলে প্রতি বার একই ভাবে ভাবতে হবে কেন?’’
তা হলে? তাঁর অভিমত, কেমন কাটতে পারত সেখান থেকে শুরু করা গেলে হয়তো অন্য কোনও ভাবনার খোরাক মিলতেও পারে! অতএব আলোচনা এগোল। এবং প্রথমেই উঠল রাজ্যের অধুনা পদচ্যুত সেই মন্ত্রীর প্রসঙ্গ।
শিক্ষক-নিয়োগ নিয়ে নজিরবিহীন কেলেঙ্কারিতে এই বছরের আধখানা জুড়ে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সশরীরে বিরাজমান। তাঁর ছড়ানো পাঁকে কারা কতটা ডুবেছেন বা আরও কারা ডুববেন, তা পরের কথা। কিন্তু এটা মানতেই হয়, বছরের আলোচনায় তিনি এ বারের অন্যতম প্রধান চরিত্র। বলা চলে, ‘খলনায়ক’!
আরও সাব্যস্ত হল, সেই মন্ত্রিবর পার্থ ও তাঁর মেয়ের বয়সি ‘বান্ধবী’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের আস্তানা থেকে যদি কয়েকশো কোটি নগদ টাকা ধরা না-পড়ত, তা হলে আজও ত্রিভুবন জানত, ‘অল ইজ ওয়েল’! আর তাতে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির হিমশৈলও হয়তো অনির্দিষ্টকাল ধরে অতলেই ডুবে থাকত এবং শত শত ‘অযোগ্য’ শিক্ষক বছরের পর বছর স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের ‘শিক্ষা’ দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য আরও বড় বিপদের গহ্বর খনন করে যেতেন!
বাংলাকে সেই অনিবার্য ভরাডুবির হাত থেকে এ বার সত্যি যদি রক্ষা করা যায়, তা হলে বলতেই হবে, ২০২২ একটি ‘শুভ’ সঙ্কেত এনে দিতে পেরেছে। আঁধার পেরোলে আলো। বছরটা সে দিক থেকে মন্দ নয়!
সূচনাও খুব মন্দ ছিল না। কোভিড-আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে আসে এই বছরেই। দু’-আড়াই বছরের দমবন্ধ যাপন কিছুটা মুক্তির স্বাদ পাওয়ায় ২০২২ নানা দিক থেকে খুশির বছর হয়ে ওঠে। সমাজ-সংসার-অর্থনীতি সব কিছুর উপর এই ইতিবাচক প্রভাব অত্যন্ত জরুরি ছিল।
দু’বছর পরে বাংলায় এই বছরের দুর্গোৎসবও ছিল আগের মতোই বাধাবন্ধহীন। বাঙালির এই জাতীয় উৎসবকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতিদানের উদ্যাপন ঘিরে যা এ-বছর আরও বর্ণময় হয়ে ওঠে। রেড রোডে ফিরে আসে বিসর্জনের কার্নিভাল। বর্ষশেষে তারকাখচিত উদ্বোধনের মঞ্চে ফিরে এসেছে ফিল্ম ফেস্টিভালও। সঙ্গে কিছু টক-ঝাল রাজনীতি। সৌজন্য, চিত্রতারকা মিঠুন চক্রবর্তী।
এককালের তৃণমূল এবং অধুনা বিজেপি মিঠুন ২০২২-এ আর এক চর্চিত নাম। গত বিধানসভা ভোটে ‘জাত গোখরো’ হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন তিনি। কার্যত ঢোঁড়া সাপের চেয়ে বেশি প্রোমোশন হয়নি! কিন্তু বছরখানেক একটু দূরে থেকে এ বার তিনি ফের বাংলায় রাজনীতির মঞ্চে ফণা তুলেছেন। ফেস্টিভালে তাঁকে আমন্ত্রণ না-জানানোর জন্য জলও তাই ঘোলা হয়েছে।
ভারতীয় সিনেমার এক কৃতী বঙ্গসন্তান মিঠুন কেন ফেস্টিভালে ডাক পেলেন না, সরকারের তরফে তার স্বচ্ছ জবাব মেলেনি। বছরের মুখ
দেখানো আয়নায় ঘটনাটি কতটা ছায়া ফেলেছে, সেই বিচার স্বতন্ত্র। তবে সঙ্কীর্ণ রাজনীতির পাশ থেকে মুক্ত হতে না-পারার একটি বার্তা এতে স্পষ্ট। বেলেঘাটার একটি মাঠে নাট্যোৎসব করতে গিয়ে শাসকবাহিনীর হাতে উদ্যোক্তাদের মার খেয়ে ফিরতে হয় কেন, ২০২২ সেই প্রশ্নও রেখে গেল। আসলে এগুলি সবই অবাঞ্ছিত প্রাপ্তি।
চলচ্চিত্রে বাংলা ও বাঙালির প্রাপ্তির ভাঁড়ার অবশ্য এই বার নেহাত অপূর্ণ নয়। বেশ কয়েকটি বাংলা ছবি বক্স অফিসে সাড়া ফেলেছে। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’, ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’, ‘অপরাজিত’ সেই তালিকার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নিয়ে ‘দোস্তজী’ প্রমাণ করেছে, সিনেমার ‘তারা’ মাটিতেও থাকে! ও পার বাংলার ছবি ‘হাওয়া’ এ পারে ঝড় তুলে আরও এক বার বুঝিয়ে দিল, এই বন্ধনের শিকড় কত গভীর।
বিজ্ঞান সাধনায় বাঙালির কৃতিত্বের ধারাবাহিকতা এই বছরেও অক্ষুণ্ণ। ব্ল্যাক হোল বিষয়ক গবেষণায় ছাপ রেখেছেন পুণের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে গবেষণায় হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী সৌমাভ ঘোষও নজরে। ভূমিকম্প নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন আরও দুই বাঙালি— প্রকাশ কুমার ও বিশ্বজিৎ মণ্ডল। এটিএম থেকে টাকা তোলার সময় গ্রাহকের সুরক্ষা বিঘ্নিত হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। এটিএমে আর্থিক লেনদেন সুরক্ষিত করার গবেষণায় দিশা দেখিয়েছেন তাপস মজুমদার, অরবিন্দ মল্লিক ও প্রভাকর পাল। ক্ষুদ্র অ্যান্টেনা তৈরিতে অভিনব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন শ্রীকান্ত পাল ও মৃণ্ময় চক্রবর্তী। উল্লেখ থাক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২ জন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন বাঙালি বিজ্ঞানীরও। এ বছর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা কৃতী গবেষকদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাঁরা সেইতালিকার অন্তর্ভুক্ত।
আর একটি বিশেষ কারণে ২০২২ বাঙালির গর্বের ইতিহাসে চিহ্নিত হওয়ার দাবি রাখে। আনন্দবাজার পত্রিকার শতবর্ষ পূর্তি হল এ বার। একশো বছর আগে যে বাংলা সংবাদপত্র ব্রিটিশের রাজরোষ উপেক্ষা করে আত্মপ্রকাশ করেছিল, স্বাধীনতা-উত্তর সময়েও বারবার শাসকদের রক্তচক্ষুর মোকাবিলা করতে করতে আজ সে মহীরুহ। বাংলা ভাষার সংবাদপত্র তো বটেই, অন্য কোনও আঞ্চলিক ভাষার সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও শতবর্ষ পেরিয়ে সগৌরব এগিয়ে চলার নজির কম। আনন্দবাজারের এই গৌরব তাই বাঙালিদেরও গর্বের।
এই বছরেও সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নতুন কোনও উদ্ভাস নেই।
‘খেলা’র ব্যঞ্জনা বহু আগেই রাজনীতির আশ্রয়ে গিয়েছে। বিশেষত বাংলায়। কে কখন কোন খেলা খেলেন, কে জানে! ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের শীর্ষ পদ থেকে ‘দাদা’ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিদায় ঘিরে যেমন হল। ওই পদ থেকে তিন বছরের মধ্যেই ‘দাদা’ সরলেন না কি তাঁকে সরতে হল? যেটাই হয়ে থাকুক, সেই সময় দাদা-র পাশে ‘দিদি’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২২-এ বাঙালির ‘খেলা’, অতএব, এই সব মশলায় জমজমাট! দীর্ঘ দু’দশক ঝুলন গোস্বামী ছিলেন ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের বোলিং-স্তম্ভ। ২৪ সেপ্টেম্বর লর্ডস-এ ভারতের জার্সিতে শেষ ম্যাচ খেলে তিনিও এ বার অবসর নিলেন। ক্রীড়াঙ্গনে আর এক বঙ্গতনয়া এ বার ‘সোনার মেয়ে’। সিনিয়র শুটিং বিশ্বকাপে ‘মিক্সড টিম’ বিভাগে সোনা জিতে বাংলা ও বাঙালির গর্ব বাড়িয়েছেন মেহুলি ঘোষ। তাঁর সঙ্গী ছিলেন শাহু তুষার মানে।
এ বছরেই দেশকে আর একটি সোনা এনে দিয়েছেন একুশ বছরের অচিন্ত্য শিউলি। কমনওয়েলথ গেমস-এ প্রথম ভারতীয় ভারোত্তোলক হিসাবে এই গৌরব অর্জন করেছেন হাওড়ার দেউলপুরের এই যুবক। এ ছাড়া, বার্মিংহামে কমনওয়েলথ গেমস-এর আসরে স্কোয়াশে পুরুষদের সিঙ্গলসে ব্রোঞ্জ জিতেছেন সৌরভ ঘোষাল। এই পদকের তালিকায় তিনিই প্রথম ভারতীয়। নিজ নিজ ক্ষেত্রে এঁরা সকলেই বাংলা ও বাঙালির গর্বের মুখ।
এই বছর আরও এক ‘মুখ’ হয়ে উঠেছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। কারও কাছে তিনি ‘রোল মডেল’। কেউ বা তাঁকে সমালোচনা করতে ছাড়েন না। কিন্তু সবের ঊর্ধ্বে স্থির সত্য হল, তাঁকে এড়িয়ে বছরের পাতা ওল্টানো কঠিন। কারণ, রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে ওঠা একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত মামলায় কলকাতা হাই কোর্টের এই বিচারপতির বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও পর্যবেক্ষণ সমাজকে নাড়া দিচ্ছে। নিত্যদিনের আলোচনায়, বিতর্কে যা সজীব।
শিল্পক্ষেত্রে এ বারের সবচেয়ে বড় খবর, তাজপুরে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরিতে আদানি গোষ্ঠীর আগ্রহ প্রকাশ। রাজ্যের সার্বিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সব মিলিয়ে প্রত্যাশা প্রচুর। বছর ফুরনোর ঠিক আগে রাজ্যের জন্য ৭৮০০ কোটিরও বেশি টাকার বিভিন্ন প্রকল্পের শিলান্যাস এবং উদ্বোধন হল প্রধানমন্ত্রীর হাতে। অন্য দিকে, রাজ্য সরকারের তরফে ইতিমধ্যেই ‘সমঝোতা পত্র’ দেওয়া হয়েছে আদানিদের। কয়লা উত্তোলনের আশা জাগিয়ে সমীক্ষা শুরু হয়েছে ডেউচা-পাঁচামি প্রকল্পেও। জল এখনও অনেক বইবে। তবু কূল মিলবে, এটাই বর্ষশেষের আশা।
তবে জীবনের স্রোত তো একমুখী বয় না। সেখানে দুঃখ থাকে। থাকে মৃত্যু, হতাশা সবই। ফেলে আসা বছরে প্রয়াণের তালিকায় নক্ষত্র-পতন অনেক। বিশেষত সঙ্গীতের আকাশে শূন্যতা এ বার বিপুল।সুরের বাঁধনে সকলকে যিনি একসূত্রে বেঁধেছেন, সেই লতা মঙ্গেশকরের কোনও গণ্ডি নেই। তাঁর প্রয়াণে প্রতিটি বাঙালি হৃদয় দীর্ণ। সেই শোক না কাটতেই আবার ধাক্কা দিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের চলে যাওয়া। বাঙালির অমলিন স্মৃতিতে শুধু রয়ে গেল তাঁর কণ্ঠের অজস্র গান। এই বছরেই চলে গেলেন বাংলা সঙ্গীত-জগতের আর এক উজ্জ্বল শিল্পী নির্মলা মিশ্র।
মুম্বইয়ে থেকেও মনেপ্রাণে বাঙালি ছিলেন যশস্বী সঙ্গীত পরিচালক ও শিল্পী বাপ্পি লাহিড়ী। তাঁর মৃত্যুও বড় আঘাত। কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে এসে ‘কেকে’ মুম্বই ফিরলেন কফিনবন্দি হয়ে! তাঁর এই আকস্মিক অকাল প্রয়াণ খুবই বেদনার।
পেলে ব্রাজিলের। কিন্তু ফুটবলের সম্রাট পেলের সাম্রাজ্য বিশ্ব-বিস্তৃত। সেই সম্রাট কলকাতায় এসেছেন। খেলেছেন মোহনবাগানের বিরুদ্ধে। তাঁর প্রয়াণে শোকাতুর বাংলাও।
কালের নিয়মেই শতায়ু বাঙালির সংখ্যা কমছে। কত জন শতায়ু নিজেদের অবস্থানকে প্রাসঙ্গিক করে রাখতে পারেন, সেটাও বলা কঠিন। তবে ২০২২-এ এমন কয়েক জন আমাদের ছেড়ে গেলেন যাঁদের কেউ শতায়ু, কেউ বা তার কাছাকাছি পৌঁছেও নিজেদের কর্মের মাধ্যমে প্রতিদিন আমাদের ঋদ্ধ করেছেন।
সারদা মঠের অধ্যক্ষা প্রব্রাজিকা ভক্তিপ্রাণা এঁদের অন্যতম। ১০২ বছরে পদার্পণ করেছিলেন আজীবন কর্মব্রতী এই সন্ন্যাসিনী।
কার্টুন-সাহিত্যে বাঙালির কয়েক প্রজন্মকে আকৃষ্ট করেছেন হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল দ্য গ্রেট, নন্টে-ফন্টের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ। ৯৭ বছরে প্রয়াত হলেন তিনি।
কীর্তিমান প্রবীণ চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদারের মৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি। বয়স হয়েছিল ৯১।
ছোট পর্দার সুপরিচিত অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মা অবশেষে মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন ভাল করে ফুটে উঠতে না উঠতেই। অফুরান জীবনীশক্তিতে আগে দু’বার ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে ফিরে এসেছিলেন তিনি। এই মৃত্যুর অভিঘাতও তাই তীব্র।
বছরের শেষবেলায় কোভিডের আশঙ্কা ফের দানা বাঁধছে। সময়ে সচেতন ও সংযত হওয়া গেলে অনেক বিপদ এড়ানো যায়। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। ২০২২ থেকে সেই ‘শিক্ষা’ নিয়ে শুরু হোক নতুন বছরের পথ চলা।
স্বাগত ২০২৩।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy