Advertisement
২৯ নভেম্বর ২০২৪

বুক ফুঁড়ছে গুলি, গরুতেই জান কবুল

পুলিশের হাত ঘুরে লাশকাটা ঘর হয়ে ঠাকুরদাসের ‘বডি’ মিলেছিল আরও একরাত পরে। সেটা ছিল ২০০৯ সালের ডিসেম্বর। গ্রাম মল্লিকপুর।

নিহত ঠাকুরদাস মল্লিকের (ইনসেটে) স্ত্রী লক্ষ্মীরানি। —নিজস্ব চিত্র।

নিহত ঠাকুরদাস মল্লিকের (ইনসেটে) স্ত্রী লক্ষ্মীরানি। —নিজস্ব চিত্র।

সুপ্রকাশ মণ্ডল
স্বরূপনগর শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৪৬
Share: Save:

কুয়াশা বড় বন্ধু। কুয়াশা বড় বেইমান।

শীতের সকালে কুয়াশা পাতলা হতে বেলা বয়ে যায়। রাতভর বাড়ি না ফেরা মানুষটাকে কোথায় না খুঁজেছিলেন লক্ষ্মীরানি মল্লিক। কুয়াশা সরতে গাঁয়ের লোকেদের নজরে পড়েছিল উত্তুরে হাওয়ায় কাঁটাতারে পতপত করে ওড়া ঠাকুরদাস মল্লিকের গামছাখানা।

পুলিশের হাত ঘুরে লাশকাটা ঘর হয়ে ঠাকুরদাসের ‘বডি’ মিলেছিল আরও একরাত পরে। সেটা ছিল ২০০৯ সালের ডিসেম্বর। গ্রাম মল্লিকপুর। থানা স্বরূপনগর। গ্রাম থেকে পা বাড়ালেই ও পারে। মানে বাংলাদেশে।

একচিলতে ঘরের উঠোনে বসে কথা বলছিলেন বছর চল্লিশের লক্ষ্মীরানি। “বারবার বলতাম, ওই কাজে জড়িয়োনা। শোনেনি। বলেছিল ঘন কুয়াশা রয়েছে. বিএসএফ কিচ্ছুটি টেরও পাবে না। পরে শুনেছিলাম কুয়াশা ছিল বলেই মোবাইলের টর্চ জ্বালতে হয়েছিল। আর তাতেই নজরে পড়ে বিএসএফ-এর। কুয়াশাই বেইমানি করল।” খানিক থেমে লক্ষ্মীরানি বলেন, “একটা বেড়ার ঘর, আর তিনটে বাচ্চা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে চলে গেল ও। না খেয়ে মরতে হয় মরব। কিন্তু ছেলেদের আর পাচারে জড়াতে দেব না।” লক্ষ্মীরানির অভিমান-দুঃখ-রাগ মিলেমিশে পাক খায় উঠোনময়। হেঁসেলের চালে দোল খায় পুঁই লতা।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

লক্ষ্মীরানি না চাইলেও বাংলাদেশ সীমান্তের গ্রামগুলিতে চন্দ্র-সূর্যের মতোই সত্য পাচার। চাল-ডাল-নুন তেল তো বটেই, এ পার থেকে ওপারে যাওয়ার তালিকায় রয়েছে হীরে থেকে জিরে। আর ও পার থেকে এ পারে বেবাক চালান হয়ে যায় সোনা-রূপো এমনকি, জলজ্যান্ত মানুষও। বিএসএফ-এর পাহারা, ও পারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

তবুও পাচার অন্তহীন। সীমান্তের বাসিন্দারা বলছেন, এলাকার অর্থনীতি এবং রাজনীতি আবর্তিত হয় পাচারকে কেন্দ্র করেই।

এলাকা বদলায়, সীমানা বদলে যায়, ফারাক ঘটে পাচারের ধরনে। সে উত্তর ২৪ পরগনা কিংবা নদিয়া, মালদহ হোক বা মুর্শিদাবাদ। গাঁ-গঞ্জের খেটে খাওয়া মানুষ, যাঁরা এ পার ও পার করেন, তাঁদের যুক্তিতেও বিশেষ ফারাক নেই। কথা একটাই , ‘‘পাচার না করলে খাব কী?’’

সীমান্তের গ্রামে ভোট আসে। নেতারা প্রচারে আসেন। ঝুড়িঝুড়ি প্রতিশ্রুতি মেলে। তাতে মুচকি হাসেন স্বরূপনগর সীমান্তের হাসান মোল্লা, ইকবাল আনসারি, দীপক বিশ্বাস, স্বরূপ সরকারেরা। এক চিলতে চায়ের দোকান। ঠা ঠা দুপুরে সেখানেই আড্ডা জমে ইকবাল, হাসানদের সঙ্গে।

গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা সুজন সর্দার বলেন, “ঘাম ঝরিয়ে পরিশ্রমের থেকে এক জোড়া বড় গরু পাচার করতে পারলে ৩০-৪০ হাজার টাকা ‘পাসিং মানি’ হাতে আসে।” পাচার কেমন ভাবে সীমান্তের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে তা বুঝিয়ে দিলেন স্বরূপনগরের স্কুল শিক্ষক মোহনলাল সরকার।

মোহনবাবু জানান, এলাকার অর্থনীতির মেরুদণ্ড ছিল চাষবাস। আর সেচের একমাত্র উৎস ছিল বল্লি নামের বিলটি। কিন্তু সে বিল মজে গিয়ে গ্রীষ্মে জল শূন্য, আর বর্ষায় বাংলাদেশের জল নেমে এলাকা বানভাসি হয়। তায় ফলে কৃষির আয়ে সংসার চলে না। ফলে অনেকেই ভিন্ রাজ্য যান কাজের খোঁজে। অভিযোগ, অনেকেই জড়িয়ে পড়েন পাচারের কাজে। মোহনবাবু বলেন, “ধরা যাক কোনও এক ব্যক্তি পাচার করে পাঁচ হাজার টাকা রোজগার করল। এক হাজার টাকা সে গ্রামের মুদিখানা দোকানে খরচ করে। রোজগার ভাল হলে মুদিখানা মালিকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ পায় গ্রামের মহিলা, মাঠে মজুরের কাজ পান গ্রামেরই বাসিন্দা।” বাকি চার হাজার টাকার কিছুটা গ্রামের বিভিন্ন দোকানে আর বাকিটা কাছাকাছি শহরে খরচ হয়।

সীমান্তের গ্রাম দোবিলা, হাকিমপুর, খলসি, আমুদিয়া, বালতি, জৈপুর, মল্লিকপুরের গড়ে প্রতি তিনটি বাড়িতে একটি করে মোটরবাইক রয়েছে। চাষে রোজগার নেই, গ্রামে চাকরিজীবীর হার ৪ শতাংশ। তা হলে এত মোটরবাইক কী করে? চা দোকানের মালিক আসলাম বলেন, “সবই পাচারের পয়সা। বছরখানেক আগে আমিও তাই করতাম। ভ্যানে করে চাল-ডাল-চিনি বর্ডারে আনতে পারি। তা হলে ও পারে নিয়ে যাওয়ার লোক আছে। আর নিজে পার করতে পারলে পাঁচশো-হাজার লাভ কোনও ব্যাপার না। তবে আসল লাভ গরুতে।”

গুলিতে প্রাণ কাড়ার নজির বড় কম নেই সীমান্তে। সময় গড়ায়, দমকা হাওয়ায় ওড়া পথের ধুলোর সঙ্গেই ফিঁকে হয়ে যায় সে সব স্মৃতি। ফি রাতে নতুন দৃশ্য তৈরি হয় কাঁটাতারের এ পারে-ও পারে। সেখানে ভয়ের ঠাঁই নেই। গরুতেই জান কবুল ওঁদের।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy