Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

পাহাড়ে প্রার্থী ঘোষণা বিজেপির, সমর্থন জানিয়ে দিল মোর্চা-জিএনএলএফ

সপ্তাহ ঘুরতেই আচমকা তৃণমূলের ‘নিশ্চিত জয়’-এর অঙ্কটা বদলে গেল।

দিল্লিতে বিজেপির দফতরে মোর্চা ও জিএনএলএফের নেতারা। নিজস্ব চিত্র।

দিল্লিতে বিজেপির দফতরে মোর্চা ও জিএনএলএফের নেতারা। নিজস্ব চিত্র।

সিজার মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৯ ১৯:৫৪
Share: Save:

পাহাড়ে বিজেপিকে সমর্থন করবে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা(জিজেএফ) এবং গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (জিএনএলএফ)। এক বিবৃতি জারি করে এমনটাই জানাল বিজেপি। রবিবার দিল্লিতে কৈলাস বিজয়বর্গের উপস্থিতিতে জিজেএম-এর কার্যকারী অধ্যক্ষ লোপসং ইয়োমা এবং জিএনএলএফ-এর মুখপাত্র নীরজ জিম্বা জানান, পাহাড়ে বিজেপির জয় সুনিশ্চিত করতে একজোট হয়ে কাজ করবে তাঁদের দল। পাশাপাশি তাঁরা এটাও জানান, বিজেপির সঙ্গে তাদের জোট অটুট এবং আগামী দিনে এই সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তুলতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই চালাবে তারা।

প্রার্থী হিসেবে রাজু বিস্তার নামও উঠে আসছিল। এ নিয়ে তুমুল জল্পনাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। রাজুই যে বিজেপির প্রার্থী হচ্ছেন বিবৃতিতে সে কথাও জানানো হয়েছে।

এ মাসের গোড়া থেকেই বিচ্ছিন্ন কয়েক পশলা বৃষ্টি ছাড়া পাহাড়ের আকাশ বেশ ঝকঝকে। কিন্তু পাহাড়ের রাজনীতি ততটাই কুয়াশায় মোড়া। যদিও এমনটা হওয়ার কথা ভাবতেও পারেননি পাহাড় বা সংলগ্ন সমতলের কেউ, যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিংয়ের মোর্চা বিধায়ক অমর সিংহ রাই-এর নাম দার্জিলিং লোকসভায় তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করেন।

কিন্তু অমর সিংহ রাইয়ের নাম তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই পাহাড়ের রাজনীতিতে ঘটছে একের পর এক সমীকরণের পরিবর্তন, যা পাহাড়ের খামখেয়ালি আবহাওয়াকেও টেক্কা দিচ্ছে।

বর্তমানে পাহাড়ের ক্ষমতাসীন বিনয় তামাংপন্থী গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রথম সারির নেতাকে পাহাড়ের মানুষ হাত উপুড় করে ভোট দেবেন এমনটাই ছিল সরল পাটিগণিত। আর সেই হিসেব কষেই পাহাড়ের দায়িত্বে থাকা শাসক দলের প্রথম সারির নেতাদের মুখে ছিল চওড়া হাসি, সঙ্গে অব্যক্ত বার্তা—— ‘কেমন দিলাম চালটা’।

রবিবার সন্ধ্যাতেই মোর্চার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে প্রার্থী হিসাবে রাজু বিস্তার নাম ঘোষণা হয়।

আরও পড়ুন: ‘নর্তকী স্বপ্নাকে বিয়ে করুন রাহুল, রাজীবও তাই করেছিলেন’, কদর্য আক্রমণ বিজেপি বিধায়কের​

কিন্তু সপ্তাহ ঘুরতেই আচমকা তৃণমূলের ‘নিশ্চিত জয়’-এর অঙ্কটা বদলে গেল। সুবাস ঘিসিংয়ের গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (জিএনলএফ) এবং বিমল গুরুঙ্গপন্থী গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা (জিজেএম) অতীতের সমস্ত তিক্ততা-শত্রুতা ভুলে হাতে হাত মেলানোয়। যে বিমল গুরুঙ্গ সুবাস ঘিসিংকে পাহাড় ছাড়া করেছিলেন, সুবাসের স্ত্রীর মরদেহ পাহাড়ে উঠতে দেননি, সেই বিমলের সঙ্গে হাত মেলাবেন সুবাসের ছেলে মন ঘিসিং— এমনটা পাহাড়ের মানুষের কাছেও একটা বড় চমক। সরল পাটিগণিতের হিসেব উল্টে দিয়ে, দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বীর জোট গোর্খা জাতিস্বত্ত্বাকে সামনে রেখে চলতি মাসেই ঘোষণা করে বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার।

যদিও দার্জিলিং জেলা তৃণমূল সভাপতি এবং রাজ্যের মন্ত্রী গৌতম দেব বলছেন, “কে কোথায় জোট করল তা নিয়ে তৃণমূল আদৌ চিন্তিত নয়। তবে জিএনএলএফেরও মনে রাখা উচিত, ২০০৭ সালে অগ্নিগর্ভ পাহাড়ে বিমল গুরুঙ্গ কী ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাঁদের সঙ্গে।” পাহাড়ের অন্য এক তৃণমূল নেতারও দাবি, “বিমল গুরুঙ্গের পাহাড়ে আর কোনও প্রভাব নেই।” বিমলের প্রভাব নিয়ে বিতর্কের মধ্যেও পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৪ সালে গুরুঙ্গের একাধিপত্যের মধ্যেই পাহাড়ের তিনটি আসনে (দার্জিলিং, কালিম্পং এবং কার্শিয়ঙ)-এ প্রায় ৯১ হাজার ভোট পেয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী ভাইচুং ভুটিয়া। পাহাড় রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, পাহাড়ে কোনও সংগঠন ছাড়া ভাইচুং ওই ভোট পেয়েছিলেন, কারণ জিএনএলএফ সেই সময় তৃণমূলকে সমর্থন করেছিল।

মোর্চার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে রাজু বিস্তার পরিচয়ও দেওয়া হয়।

অন্য দিকে তৃণমূল পাহাড়ে বিমলকে কোনও ফ্যাক্টর মনে না করলেও, বিমল শিবির থেকে বিনয় তামাং শিবিরে আসা গোর্খা যুব মোর্চার এক নেতার কথায়, “পাহাড়ে প্রত্যন্ত এলাকায়, বিশেষ করে চা-বাগান এলাকায় এখনও বিমলের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেক মানুষ আছেন।” তিনি ইঙ্গিত দেন যে, সেই সমর্থন আরও বেড়েছে যে দিন বিনয় তামাং গোর্খাল্যান্ড দাবি থেকে সরে এসেছেন। গত শনিবার বিনয় তামাং মন্তব্য করেন, ‘‘আমরা আপাতত গোর্খাল্যান্ড নিয়ে কোনও কথা বলব না।” বিনয়ের ওই বক্তব্য ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে পাহাড়ের বুকে। পাহাড়ের মানুষের বিমল গুরুঙ্গের প্রতি আনুগত্য কতটা আছে তার থেকেও এখন বড় প্রশ্ন, মোর্চা নেতার তৃণমূলের প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাটা পাহাড়ের মানুষ কী ভাবে নেবেন?

আর সেই জাতিসত্ত্বার আবেগেই ইন্ধন দিয়ে আলাদা আলাদা করে বিবৃতি দিয়েছেন মন ঘিসিং এবং বিমল গুরুঙ্গ। প্রায় এক বছর পর ফের ভিডিয়ো বিবৃতি দিয়ে বিজেপিকে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি পাহাড়ে ফিরে আসার কথা বলেছেন বিমল।

পরিবর্তিত সমীকরণে যখন ফের একবার পাহাড়ের আসন ধরে রাখার জোরালো আশার আলো দেখা দিচ্ছে গেরুয়া শিবিরের সামনে, তখন নিজেদের প্রার্থী বাছাই করতেই নাজেহাল দশা তাঁদের। দিল্লিতে শিবির করে থাকা জিএনএলএফের এক শীর্ষ নেতা রবিবার বলেন, ‘‘সুরেন্দ্র অহলুওয়ালিয়ার নাম বিজেপির তরফে প্রস্তাব করা হলে আমরা প্রথমেই বিরোধিতা করি। কারণ তিনি পাহাড়ে সাংসদ হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন।” অহলুওয়ালিয়া নিয়ে জিএনএলএফের মত বিরোধিতা করেছেন বিমল পন্থী মোর্চা নেতারাও। আর সেখান থেকেই নাম উঠে আসে সত্যপাল রাওয়াত বা সত্যপাল মহারাজের। উত্তরাখণ্ডের বিজেপি সরকারের পর্যটনমন্ত্রী সত্যপাল মহারাজের সরাসরি পাহাড়ের কোনও যোগ না থাকলেও, একজন ধর্মীয় গুরু হিসাবে তিনি পাহাড়ে অত্যন্ত জনপ্রিয়। গত ডিসেম্বরেও তিনি পাহাড়ে একাধিক অনুষ্ঠান করেন। সেখানকার উপচে পরা ভিড় তাঁর গ্রহণযোগ্যতাকেই শিলমোহর দেয়। সেই সঙ্গে সমতলের অবাঙালি ভোটারদের মধ্যেও রয়েছে তাঁর প্রভাব। মোর্চা সূত্রের খবর, সেখানেও সমস্যা তৈরি হয়, কারণ সত্যপাল মহারাজ নিজেই আগ্রহী নন পাহাড়ে প্রার্থী হতে। ফলে খোঁজ শুরু হয় তৃতীয় নামের। সূত্রের খবর জিএনএলএফ নেতা নীরজ জিম্বা এবং মন ঘিসিং প্রথম সারির মোর্চা নেতাদের সঙ্গে শিবির করে রয়েছেন নয়া দিল্লিতে। সেখানে পর পর বৈঠকে উঠে আসে রাজু বিস্তার নাম।

আরও পড়ুন: ‘আমার স্ত্রীর ব্যাগে ২ গ্রাম সোনা ছিল দেখাতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেব’

তরুণ রাজু মূলত অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এক বেসরকারি সংস্থার শীর্ষ পদে রয়েছেন ৩৩ বছরের ঝকঝকে ওই যুবক। মাটিগাড়ার বাসিন্দা রাজুকেই পাহাড়ের তরুণ প্রজন্মের সামনে নতুন নেতা হিসাবে তুলে ধরতে চাইছেন পাহাড়ের নেতারা। মোর্চা নেতৃত্বের দাবি, রাজুকে প্রার্থী হিসাবে মেনে নিয়েছেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বও। কারণ সে ক্ষেত্রে রাজু, অহলুওয়ালিয়া বা সতপাল মহারাজের মত বহিরাগত নন, ভূমিপুত্র। বিজেপি সরকারি ভাবে দার্জিলিংযের প্রার্থীর নাম ঘোষণা না করলেও, রবিবার সন্ধ্যায় বিমল পন্থী মোর্চা তাঁদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে রাজুর নাম প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করে। আর তা নিয়েই শুরু হয় নতুন জল্পনা।

এ দিকে রাজু বিস্তার নাম ঘোষণা হওয়ার পরই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বিমলপন্থী শিবিরের অন্যতম শীর্ষনেতা স্বরাজ থাপা দল ছাড়ার কথা জানান। মোর্চা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিজেপি ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলে ফেসবুকে বিবৃতিও দেন তিনি।

(বাংলার রাজনীতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার আবহাওয়া -পশ্চিমবঙ্গের সব টাটকা খবর আমাদের রাজ্য বিভাগে।)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE