কলেজ স্ট্রিটের শতাব্দী প্রাচীন শীতলা মন্দির তালাবন্ধ। নিজস্ব চিত্র।
যে সে দেবতা নয়, একেবারে কাঁচা-খাওয়া দেবতা। শতাধিক বছর ধরে কলকাতাকে অসুখবিসুখের হাত থেকে আগলে রেখেছিলেন। সেই দেবতাই আজ আক্রান্ত।
চৈত্রর মাঝামাঝি। সূর্য সদ্য পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। ‘বর্ণপরিচয়’-এর লম্বা ছায়া বিধান সরণির উপর।। সুনসান রাস্তা। কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের সামনে ফলের পসরা সাজিয়ে ঝিমোচ্ছেন বিক্রেতারা। উল্টো দিকে মন্দিরের শাটার নামানো। শীতলা মন্দির। মা শীতলা আজ তালাবন্দি। লকডাউন চলছে!যদিও সপ্তাহ দেড়েক আগেই শহর কলকাতার অন্যতম প্রাচীন এই মন্দিরের চেহারাটা ছিল অন্য রকম। গত ১৭ মার্চ শীতলা অষ্টমীর গোটা দিন মন্দিরের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে পুলিশকেও। পুজো দেওয়ার পাশাপাশি কেউ মানত করছেন, কেউ ভোগ নিচ্ছেন। সেই উৎসবের চিহ্ন এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে মন্দিরের সামনে লাগানো শুকনো ফুলের মালাগুলো।
বন্ধ শাটারের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারলে চোখে পড়ে পুরোহিত রাস্তার দিকে পা করে লম্বা হয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মন্দিরের পুরোহিতের ঘুম না ভাঙলেও, পাশের গলিপথে বেরিয়ে এলেন বছর তিরিশের শতরূপা মুখোপাধ্যায়। তাঁদেরই পারিবারিক মন্দির। উঁকিঝুঁকি মারতে দেখে বললেন, ‘‘মন্দির এখন বন্ধ। বিকালে আসুন।’’ তাঁর কথায় জানা গেল, করোনাভাইরাস ঠেকাতে লকডাউন ঘোষণার পরেও সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে দু’বেলা মন্দির খোলা হচ্ছে। বিগ্রহের নিয়মমাফিক পুজো করছেন বেতনভুক পুরোহিত। কিন্তু হাতে গোনা তিন-চার জনের বেশি ভক্ত বা দর্শনার্থী আসছেন না মন্দিরে। শতরূপা বা তাঁর মা পাপিয়া মন্দিরের প্রতিষ্ঠা কবে তা নিয়ে সঠিক তথ্য দিতে না পারলেও দাবি করেন যে, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও তাঁদের মন্দিরে পুজো দিয়ে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন রাজ্যে আরও ৩ জনের করোনা, আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ১৮
কলেজ স্ট্রিটের শীতলা মন্দিরের দেবীমূর্তি। লকডাউনের আগে তোলা ছবি। নিজস্ব চিত্র।
মুখোপাধ্যায় পরিবারের শীতলা মন্দিরের থেকে আর একটু দক্ষিণে গেলে লেডি ডাফরিন হাসপাতালের গা দিয়ে চলে গিয়েছে স্কট লেন। সাবেক কলকাতায় এই পাড়ার নাম ছিল চাঁপাতলা। এখানেও রয়েছে শীতলা মন্দির। শহর কলকাতার প্রাচীন শীতলা মন্দিরগুলোর অন্যতম। সেখানেও দেখা গেল দরজায় তালা। অনেক ডাকডাকিতেও হদিশ পাওয়া গেল না কারওর। গা লাগোয়া বাড়ির এক বাসিন্দা জানালেন, মন্দিরে পুরোহিত নিত্যপূজা করেন বটে, তবে ভক্তদের জন্য বন্ধ মন্দির। কারণ কোভিড-১৯!
অথচ দেবী শীতলার সঙ্গে মহামারির তো অবিচ্ছেদ্য যোগ! সাবেক কলকাতায় মানুষের বিশ্বাস ছিল, গর্দভবাহন এই দেবীই শহর কলকাতাকে রক্ষা করেছেন গুটি বসন্তের মহামারি থেকে। এশীয় বিষয়ের গবেষক রাল্ফ ডব্লিউ নিকোলাস তাঁর লেখা ‘দ্য গডেস শীতলা অ্যান্ড এপিডেমিক স্মল পক্স ইন বেঙ্গল’ প্রবন্ধে দেবী শীতলাকে বসন্ত রোগের দেবী বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, আদতে ছোটখাটো লৌকিক দেবী শীতলা অষ্টাদশ শতকে বসন্ত রোগের দেবী হিসাবে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম প্রধান আরাধ্যা দেবী হিসাবে নিজের জায়গা করে নেন।অন্যতম প্রধান আরাধ্যা হিসাবে শীতলার স্থান করে নেওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত দেবী শীতলাকে নিয়ে একটি কাব্যের ব্যাখ্যায়। প্রকাশিত কাব্যে বলা হয়েছে,
‘‘বসন্ত আনিয়া দেবী কহেন জ্বরাসুরে।কার দেশে পূজা লবে বলহ আমারে।।জ্বরাসুর বলেন পূজার সব হেতু।চন্দ্রবংশ নরপতি, নাম চন্দ্রকেতু।।
অর্থাৎ, জ্বরাসুর আগে রোগ ছড়াবে। পরে গিয়ে দেবী সেই রোগ সারাবেন। কাব্যের সঙ্গে রোগের প্রাদুর্ভাবের সময়কে এক সুতোয় বেঁধেছেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিকিৎসক জে এইচ হলহয়েল। তিনি দাবি করেছেন, স্থানীয় (বাংলা) কাব্যে শীতলার উল্লেখ এবং হুগলি নদীর তীরে কলকাতায় বসন্ত রোগ মহামারির আকার ধারণ করা— সমসাময়িক। ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ উল্লেখ, ১৮৪৯-’৫০ সালে ১৬ মাসের গুটিবসন্তের মহামারিতে কলকাতা শহরে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৬১০০ জন। ১৮৫০ সালে স্মল পক্স কমিশনারের একটি রিপোর্ট থেকে পাওয়া যায়, ১৮৩২ থেকে প্রতি চার-পাঁচ বছরের ব্যবধানে গুটিবসন্ত কলকাতায় ফিরে এসেছে মহামারির আকার নিয়ে। প্রতি বারেই এ রকম বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের আগে শুরু হয়েছে প্রাদুর্ভাব। প্রতি বারেই প্রায় ১৬ মাস স্থায়ী হয়েছে মহামারি, কেড়ে নিয়েছিল প্রায় ১৪ হাজার মানুষের প্রাণ। শ্যামপুকুর, কলুটোলা, মুচিপাড়া, তালতলা, বড়তলা এলাকায় ওই রোগে প্রাণ হারিয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি মানুষ।
আরও পড়ুন নিজেদের ক্যাম্পাসে ১০০০ বেডের হাসপাতাল তৈরির প্রস্তাব রাজ্যের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের
লেবুতলা পার্কের প্রাচীন জোড়া শীতলা মন্দির, যা লকডাউনের জেরে তালাবন্ধ। নিজস্ব চিত্র।
কলকাতা শহরের পুরনো শীতলা মন্দিরগুলোর বেশির ভাগই এই সমস্ত জায়গাতেই তৈরি হয়েছিল। এর থেকেই বোঝা যায়, মহামারি রুখতে শহর কলকাতার মানুষের কতটা আস্থা জুটিয়ে নিয়েছিলেন এই লৌকিক দেবী যাঁর উল্লেখ স্কন্ধপুরাণ থেকে বৌদ্ধ গ্রন্থে পাওয়া গেলেও কখনওই প্রথম সারির দেবী হিসাবে স্বীকৃত ছিলেন না। বরং দেবীর থেকে অপদেবী হিসাবে যে তাঁকে বেশ সমীহ করে চলেন সবাই তার উদাহরণ মেলে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘নয়নচাঁদের ব্যবসা’ গল্পে। সেখানে সকলে শীতলা সম্পর্কে নয়নচাঁদকে বলছেন, ‘‘সাবধান! কাঁচা-খাওয়া দেবতা!”
উত্তরে নয়নচাঁদ বলেন, ‘‘এ বাপু ঘেঁটু নয়, পেঁচো নয়। তোমার মাণিকপীর নয়। এ মা শীতলা! ইংরেজি খবরের কাগজে পর্যন্ত মার নাম বাহির হইয়াছে।’’
বসন্তের দেবী হিসাবে মূল পরিচয় হলেও কালক্রমে, কলেরা থেকে প্লেগ, যে কোনও মহামারির ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে মানুষ শরণাপন্ন হয়েছেন এই দেবীর, যাঁর হাতে ঝাঁটা এবং জলের ঘট। ভক্তদের ব্যাখ্যায়, ওই ঝাঁটা দিয়ে দেবী সমস্ত জীবাণু নষ্ট করে জল দিয়ে রোগ নির্মূল করেন।
এ হেন মহামারির দেবীই কোবিড-১৯-এর অতিমারির সময়ে তালাবন্দি! স্কট লেন থেকে কয়েকশো গজ দূরে লেবুতলা পার্কের কাছে জো়ড়া শীতলামন্দির। গোবর্ধন পন্ডিতের তৈরি এই মন্দিরও শতাব্দীপ্রাচীন। এখনও পন্ডিত পরিবারই মন্দির চালান। গোবর্ধনের বংশধর রবীন পন্ডিত বলেন, ‘‘শনি মঙ্গলবার জমজমাট পুজো হয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের জন্য আমরা সমস্ত অনুষ্ঠান বন্ধ রেখেছি।”
ভক্তরা কি আসছেন? রবীন পন্ডিতের উত্তর, ‘‘আসছেন, তবে অনেকটাই কম।” প্রশ্ন করি, করোনাভাইরাসকে কাবু করতে কি তবে মা শীতলার উপর ভরসা রাখছেন না কলকাতার মানুষ? উত্তরে রবীনবাবু বলতে চেষ্টা করেন, ‘‘আসলে সবাই ভয়ে রয়েছে। তার উপরে প্রশাসন মন্দিরে ভিড় করতে না করেছে। পুজোর ফুল, গঙ্গাজল পর্যন্ত জোগাড় করতে পারছি না। তাই মানুষ বাড়ি থেকেই ...।’’ রবীনবাবুর কথায়, ‘‘শুধু আমাদের মন্দির নয়। তালতলা বলুন বা আশপাশে যে ক’টা শীতলা মন্দির আছে সব জায়গাতেই মন্দির বন্ধ। খালি নিত্যপুজো হচ্ছে।”
ব্রিটিশ ভারত নয়। ১৯৭৫-’৭৬-এর কথা। কলেজ স্ট্রিটের মুখোপাধ্যায় পরিবারে সদ্য বিয়ে হয়ে এসেছেন পাপিয়া। তিনি এখনও মনে করতে পারেন, ‘‘সেই সময়ও খুব মায়ের দয়া (বসন্ত) হল। বাড়ি বাড়ি সবার। আর ভোর থাকতেই মানুষের ভিড় লেগে থাকত মন্দিরে। কেউ মানত করছেন, কেউ পুজো দিচ্ছেন, কেউ প্রসাদী ফুল নিয়ে যাচ্ছেন।”
মহামারির আক্রমণ আজও। কিন্তু সে দিনের চেনা ভিড় উধাও। তবে কি কলকাতা শহরে নয়নচাঁদের মতো মানুষরা কমে গিয়েছেন? যাঁরা বলতেন, ‘‘সেকালের মতো আর হাবড় হাটী ব্রহ্মজ্ঞান তেত্রিশ কোটি দেবতার পায়ে তেল দিলে আর চলিবে না। উহার মধ্যে দুই চারিটি মাতালো মাতালো দেবতা বাছিয়া লইতে হইবে। পূজা দিতে হয় সেই দুই চারিটির দাও। আর সব দেবতারা মুখ হাঁড়ি করিয়া থাকেন, থাকুন!’’
রবীনবাবুর সঙ্গে কথার ফাঁকেই কোভিড-১৯-এর উপসর্গ থেকে কী কী করণীয় তা লেখা কলকাতা পুরসভার একটা ট্যাবলো মাইকে কোভিড-১৯ নিয়ে মাইকে প্রচার করতে করতে হাজির। জোড়া শীতলা মন্দিরের পাশেই পাড়ার ক্লাব। ক্যারম খেলছিলেন কয়েক জন যুবক। মাইকে প্রচার শুনে এগিয়ে গেলেন ট্যাবলোর দিকে, পুরসভা মাস্ক আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিচ্ছে কি না খোঁজ করতে। গলির মুখে ট্যাবলো ঘিরে ভিড়। আর তার ঠিক পিছনে তালাবন্ধ গ্রিলের আড়ালে ‘বন্দি’ মহামারির দেবী!
অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy