বিশ্বানাথ দাস এবং গৌর সরকার।—নিজস্ব চিত্র।
সকাল থেকেই থমথমে জয়নগর। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার আতঙ্কের রেশ এখনও কাটেনি। গোটা এলাকা কার্যত চষে ফেলছে পুলিশ। তার মধ্যেই বিধায়কের গাড়িতে হামলা এবং তার জেরে তিন জনের মৃত্যুর ঘটনায় উঠে আসছে এলাকায় সমাজবিরোধীদের দৌরাত্মের কাহিনি। এলাকাবাসীরা জানাচ্ছেন, এর আড়ালেই রয়েছে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব।
এলাকা ঘুরে জানা গেল, শাসকদলের এই দ্বন্দ্বের বৃত্তে ঢুকে পড়ে দুই চরিত্র। তাঁদের এক জন সারফুদ্দিন খান। অন্য জনের নাম আব্দুল কাহার মোল্লা ওরফে বাবুয়া। গত কাল স্থানীয় পেট্রল পাম্পে জয়নগরের বিধায়ক বিশ্বনাথ দাসের গাড়িতে হামলায় যে তিন জন মারা গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন এই সারফুদ্দিন। তৃণমূলের জয়হিন্দ বাহিনীর জয়নগর টাউন শাখার সভাপতি সারফুদ্দিন ছিলেন বিশ্বনাথের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এলাকাবাসীর দাবি— যে গাড়িতে গতকাল হামলা চালানো হয়, কালো রঙের সেই স্করপিওটি ছিল সারফুদ্দিনের। গত তিন মাস ধরে ওই গাড়িটিই চড়তেন বিশ্বনাথ। বিধায়ক যদিও জানিয়েছেন, তিনি গাড়িটি ভাড়ায় নিয়েছিলেন।
এলাকায় কুখ্যাত দুষ্কৃতী হিসাবেই সারফুদ্দিনের পরিচিতি। এর আগে মাদক মামলায় তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। গত বছর খোকন নামে এক তৃণমূল কর্মী খুনের ঘটনায় তিনি ছিলেন অন্যতম অভিযুক্ত। তার মাছের ব্যবসাও ছিল। সেই ব্যবসার সুবাদেও প্রচুর গণ্ডগোলের নায়ক ছিলেন এই সারফুদ্দিন। পুলিশ জানিয়েছে, এই মুহূর্তে দু’টি খুনের মামলা ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে মোট ৮টি মামলা চলছিল। কিন্তু এমন এক জনকে দলের শাখা সংগঠনের সভাপতি কী ভাবে করা হল? জয়নগরে তৃণমূলের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান গৌর সরকার জানালেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না। সারফুদ্দিনের ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট থেকেই তিনি জানতে পেরেছিলেন, ওই যুবকের সভাপতি হওয়ার খবর। তাঁর কথায়, ‘‘সারফুদ্দিন কী ভাবে সভাপতি হয়েছিল আমরা কেউ জানি না। কার সুপারিশে হয়েছিল, জানি না সেটাও।’’ দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা তৃণমূলের সভাপতি শুভাশিস চক্রবর্তীর অবশ্য বক্তব্য, ‘‘দস্যু রত্নাকরও তো বাল্মিকী হয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে তো মাওবাদীরাও সমাজের মূল স্রোতে ফিরে এসেছেন। এখানে সমস্যা কোথায়!’’
আরও পড়ুন: শাসকের অন্দরের রেষারেষিই কারণ, তদন্তে ইঙ্গিত তেমনই, জয়নগর কাণ্ডে ধৃত ১১
তৃণমূলের একটা অংশ জানাচ্ছে, বিধায়কের সঙ্গে এমন এক জন দুষ্কৃতীর ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রকাশ্যে সরব হয়েছিলেন গৌর। তিনি নিজে এ নিয়ে দলের ঊর্ধতন নেতৃত্বকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছিলেন বলে দাবি করেন। তাঁর কথায়, ‘‘এক জন ক্রিমিনালকে নিয়ে কী করে ঘুরতেন বিধায়ক? এতে তো দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি এসইউসি, সিপিএমের বিরুদ্ধে অনেক লড়াই করে এই জায়গায় দলকে এনেছি। আমার মনে হয়েছে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই আমি প্রতিবাদ করেছি।’’
আর এখানেই উঠে আসছে আব্দুল কাহার মোল্লা ওরফে বাবুয়ার নাম। তৃণমূল কর্মীদের একাংশ বলছেন, এই বাবুয়া অত্যন্ত সক্রিয় তৃণমূল কর্মী। এক সময় বিশ্বনাথের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সারফুদ্দিনের মতো তাঁরও মাছের ব্যবসা রয়েছে। কিন্তু, সারফুদ্দিন যখন থেকে বিশ্বনাথের ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেন, বাবুয়ার জায়গা নষ্ট হয়ে যায় বলে স্থানীয়দের মত। সারফুদ্দিনের সঙ্গে বাবুয়ার ব্যক্তিগত পর্যায়ে লড়াই শুরু হয়ে যায়। বাবুয়ারও অপরাধমূলক কার্যকলাপের রেকর্ড রয়েছে। তার পর থেকেই তিনি জয়নগরে তৃণমূলের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান গৌর সরকারের লোক হিসাবেই পরিচিত। অভিযোগ, সেই কার্যকলাপকে প্রশ্রয় দেন গৌর। গত বছর নিমপীঠে একই রকম ভাবে সারফুদ্দিনের গাড়ি আক্রান্ত হয়। তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে বাবুয়া তখন গ্রেফতার হয়েছিলেন। তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, বাবুয়াকে ছাড়িয়ে আনার পিছনে গৌরের একটা বড় ভূমিকা ছিল।
অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।
সারফুদ্দিন খুনে সেই বাবুয়ার নামই প্রকাশ্যে এসেছে আবার। এই ঘটনায় যে ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বাবুয়ার ভাই রাজাও। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, বিধায়কের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন, এই হামলা এবং খুনের ঘটনায় বাবুয়া থাকতে পারেন। কারণ, বাবুয়ার সঙ্গে বিশ্বনাথের দীর্ঘ দিনের বিরোধ রয়েছে। বাবুয়া কি তাঁর ঘনিষ্ঠ? জবাবে গৌর বলছেন, ‘‘হ্যাঁ, বাবুয়া আমাদের কর্মী। কর্মী হিসাবে ওর বাড়িতে দু’এক বার গিয়েওছি।’’ এমনকি রাজাকে গ্রেফতার করার পর তাঁর পরিবারের লোকজন গৌরের বাড়িতে গিয়ে ‘দরবার’ও করেন। গৌরের দাবি, তিনি তাঁদের জানিয়েছেন, আইন আইনের পথেই চলবে।
আরও পড়ুন: জয়নগরে তৃণমূল বিধায়কের গাড়িতে গুলি, বোমাবৃষ্টি, বিধায়ক বাঁচলেও নিহত ৩
তবে গৌর-বিশ্বনাথের দ্বন্দ্ব যে আড়ালে নেই, সেটাও জয়নগর ঘুরলে টের পাওয়া যাচ্ছে। গৌর বলছেন, ‘‘এখানে বেশ কিছু লোক তৃণমূলের মুখোশ পরে তোলাবাজি চালাচ্ছে। আমি তার প্রতিবাদ করি বলে, অনেকে বলার চেষ্টা করছে, এই হামলা-খুনের ঘটনার পিছনে আমার হাত আছে। খবর নিন, কে কোথায় তোলাবাজি চালাচ্ছে। কার শ্যালক কোথায় কোথায় তোলাবাজি চালাচ্ছে!’’
গৌর কোন দিকে ইঙ্গিত করছেন? এলাকাবাসীর একাংশ মনে করিয়ে দিচ্ছেন তুহিন বিশ্বাসের কথা। সম্পর্কে তিনি বিশ্বনাথের শ্যালক। জয়নগরে যুব তৃণমূলের সভাপতি তুহিন। তৃণমূলের একাংশের অভিযোগ, শ্যালক-ভগ্নিপতি মিলে এলাকায় তোলাবাজি চালাচ্ছেন। আর গৌর তারই প্রতিবাদ করছেন। তুহিনের পাল্টা অভিযোগ, ‘‘সাট্টা, মদের ঠেক থেকে পয়সা তোলেন কারা, সবটাই জানি আমরা। বিধায়ক তার প্রতিবাদ করেন সব সময়।’’ তাঁর অনুগামীদের একাংশের দাবি, গৌর সরকারের পদত্যাগ করা উচিত। তিনি দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করছেন বলেও অভিযোগ তাঁদের। এ দিন দুপুরে স্থানীয় বহুড়া দলীয় কার্যালয়ে গিয়েছিলেন শুভাশিস। সেখানে কর্মীরা তাঁকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখায়। গৌরের পদত্যাগের দাবিও ওঠে। মূলত বিশ্বনাথের সমর্থকেরা ওই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ছিলেন বলে গৌরপন্থীদের দাবি। এই ঘটনায় যে আইন আইনের পথে চলবে, সে কথাই জানিয়েছেন জেলা সভাপতি।
তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ছবিটা এ ভাবেই সামনে চলে এল।
বিশ্বনাথের দাবি, ‘‘আমাকেই খুন করতেই চেয়েছিল দুষ্কৃতীরা। কিন্তু, কোনও ভাবে তাঁর আগে নেমে পড়াটা জানতে পারেনি তারা। তাই, বেঁচে গিয়েছি।’’ কিন্তু গৌরের দাবি, ‘‘বিধায়ক কী এমন কাজ করেছেন যে তাঁকে খুন করতে হবে!’’ গৌর জানাচ্ছেন, বিধায়ক প্রাতর্ভ্রমণে যান প্রত্যেক দিন। সেই সময় কোনও নিরাপত্তারক্ষীও থাকেন না। বিধায়ক লক্ষ্য হলে তো সেই সময়েই তাঁকে খুন করে দেওয়া যায়। গৌরের কথা থেকে পরিষ্কার, বিশ্বনাথ কোনও ভাবেই দুষ্কৃতীদের লক্ষ্য ছিলেন না। তা হলে সারফুদ্দিনই লক্ষ্য ছিল? এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি গৌর। গৌর-বিশ্বনাথ দ্বন্দ্ব যে প্রকাশ্যে এসে পড়েছে, তার প্রমাণ মিলল এ দিন জয়নগর থানার সামনে। সেখানে গৌর শিবিরের লোক হিসাবে পরিচিত স্থানীয় দুর্গানগর অঞ্চলের সভাপতি কালীপদ সর্দারকে মারধর করা হয়। পরে পুলিশ গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy