সম্প্রতি এখানেই বাড়ি-সহ ভূগর্ভে তলিয়ে গিয়ে মৃত্যু হয় অন্ডালের জামবাদের এক মহিলার। ফাইল চিত্র
অবৈধ কয়লা কারবারের খবর প্রশাসন-পুলিশের কাছে না থাক, ধসের খবর আছে।
২০১০। দাউদাউ করে জ্বলছে পশ্চিম বর্ধমানের রানিগঞ্জের জেকে নগরের ভূগর্ভ। খবর গেল রাজভবনে। ছুটে এলেন তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী।
২০১০...১১...১৩... থেকে ২০২০। মাটি ফাটার চড়-চড় শব্দ, ভূগর্ভে তলিয়ে গিয়ে মৃত্যু, ধসে পড়া বাড়ির ছাদ— ধসের ধারাবাহিক ইতিহাসে বারবার বিপন্ন হয়েছে পশ্চিম বর্ধমান জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার জনজীবন। যত বার ধস, তত বারই অভিযোগ—এ জন্য দায়ী এই আসানসোল-রানিগঞ্জ-জামুড়িয়া-সহ নানা এলাকার অবৈধ কয়লার কারবার। ভোট আসে, ভোট যায়। ভোটে প্রচারের বিষয় হয় ধস, পুনর্বাসন। কিন্তু ‘কয়লাকুঠির দেশ’-এ এ সবই স্রেফ শব্দ হয়ে থেকেই যায়, অভিযোগ বাসিন্দাদের একাংশের।
২০০৭-এ আসানসোলের কালীপাহাড়িতে ২ নম্বর জাতীয় সড়কের একাংশে ধস, ফাটল দেখা যায়। স্মৃতি হাতড়ে ‘সাউথ বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ়’-এর কার্যকরী সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ খেতান বলেন, ‘‘প্রায় আড়াই মাস পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলে ভীষণ সমস্যা হয়েছিল। প্রভাব পড়েছিল এলাকার অর্থনীতিতে।’’ ২০১১-য় অণ্ডালে, ২০১৩-য় ডিসেরগড়ে, ২০২০-তে অণ্ডালের জামবাদে ভূগর্ভে তলিয়ে গিয়ে যথাক্রমে মৃত্যু হয় দুই শিশু-সহ একই পরিবারের চার জনের, এক কিশোরী এবং এক মহিলার।
২০১৮-য় জামুড়িয়ার চুরুলিয়ায় মাটি ফুঁড়ে উঠে আসা ঝাঁঝাল গ্যাস, আগুন, ধোঁয়ায় চোখ জ্বলেছিল এলাকাবাসীর। এমনই আতঙ্ককে সঙ্গী করে সালানপুরের সামডির বাসিন্দাদের একাংশ ভিটে ছাড়েন। ভ্রমর চন্দ নামে এক বাসিন্দা বলে চলেন, ‘‘সামডিতে ২৫ বছরের তেলেভাজার দোকান ছিল। দোকানের তলার কয়লার স্তর পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। এখন মনে হয়, দোকান যে কোনও সময় তলিয়ে যাবে। ভয়ে দোকান ছেড়ে খুঁটে খাচ্ছি।’’
‘‘জীবন এখানে সুতোয় দোলে’’, খানিক আবেগপ্রবণ শোনায় সামডির লহাটের মিষ্টির দোকানদার ভবানী সেনের গলা। তাঁর দোকানও ধসে বিপন্ন। এখনও দোকান খোলেন। তবে জানেন না, কত দিন খুলতে পারবেন। পক্ষান্তরে, কেন্দা গ্রাম রক্ষা কমিটির সভাপতি বিজু বন্দ্যোপাধ্যায়, ডিসেরগড় ভিলেজ কমিটির বিমান মুখোপাধ্যায়দের ক্ষোভ, ‘‘অবৈধ ভাবে কয়লা কাটার জন্য এক দিন পাঁচ-ছ’টি গ্রাম হয়তো তলিয়ে যাবে।’’
আদতে অবৈধ কয়লা-খননের প্রভাব কী? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবীণ খনি বিশেষজ্ঞ জানান, ভূগর্ভে সুড়ঙ্গ কেটে কয়লা তোলার পরে, ফাঁপা অংশে বালি ভরাট বা মাটির উপরের অংশ ধরে রাখার খুঁটির ব্যবস্থা করে না কয়লা-মাফিয়া। ফলে, এক সময়ে ভূপৃষ্ঠের ওজন সহ্য না করতে পেরে ধস নামে। দ্বিতীয়ত, সুড়ঙ্গ খুঁড়ে কয়লা তোলা হয়। কিন্তু সুড়ঙ্গ-মুখ (‘র্যাট হোল’) বন্ধ না করায় ভূগর্ভে বাইরের বাতাস ঢোকে। কয়লা স্তরে বেরনো মিথেন গ্যাসের সঙ্গে অক্সিজেনের সংস্পর্শে আগুন ধরে যায়। কখনও বছরের পরে বছর জ্বলতে থাকা সে আগুন পুড়িয়ে দেয় ভূগর্ভে সঞ্চিত কয়লার স্তর। কয়লা পুড়ে যাওয়ায় মাটির উপরের অংশ ধসে যায়।
এই পরিস্থিতিতে কী করণীয়? ‘ডিরেক্টর জেনারেল মাইনস সেফটি’-র (ডিজিএমএস) ডেপুটি ডিরেক্টর উজ্জ্বল তা বলেন, ‘‘অবৈধ খাদানের বিষয়টি আমাদের এক্তিয়ারে পড়ে না।’’ স্থানীয় ভাবে ইসিএল পাম্পে উচ্চ চাপে জলের সঙ্গে বালি মিশিয়ে ধসের গর্তে ঢালে। জলের স্রোতে বালি যত দূর যায়, সেই অংশটুকু অন্তত ভরাট হয়। কিন্তু মাটির নীচের আগুন তাতে নেভে না। ইসিএল-এর সিএমডি-র কারিগরি সচিব নীলাদ্রি রায় বলেন, ‘‘অবৈধ খননের জন্য বৈধ খনি, এলাকার জনজীবন, সব কিছুই বিপন্ন হচ্ছে। আমরা যতটা পারি, স্থানীয় প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে অবস্থার সঙ্গে লড়াই করি।’’
এ দিকে, শিল্পাঞ্চলের পাড়ায়-মহল্লায় দীর্ঘদিন ধরেই জোরাল পুনর্বাসনের দাবি। জেলা প্রশাসনের (পশ্চিম বর্ধমান) তথ্য অনুযায়ী, কয়লা শিল্পাঞ্চলের প্রায় ৪০ হাজার পরিবারের দেড় লক্ষ মানুষ পুনর্বাসন পাবেন। কিন্তু তা মিলবে কবে, সেটাই প্রশ্ন এই বিধ্বস্ত মানুষগুলির। যদিও পুনর্বাসন প্রকল্পের ‘নোডাল এজেন্ট’ আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের (এডিডিএ) ভাইস চেয়ারম্যান উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘জামুড়িয়া ও বারাবনিতে ১২ হাজার ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে।’’ জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজির আশ্বাস, ‘‘আশা করি, নভেম্বরের মধ্যে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শেষ হবে।’’
‘আশা’ করেন বিধ্বস্ত মানুষগুলিও। তবে যায় না আক্ষেপ। অণ্ডালের জামবাদ খোলামুখ খনির কাছে সম্প্রতি ধস নামে। বাড়ি-সহ তলিয়ে যান শাহনাজ বেগম নামে এক মহিলা। সাত-আট দিন বাদে মাটির ৬০ ফুটেরও বেশি নীচ থেকে মেলে তাঁর দেহ। তাঁর স্বামী মিরাজ শেখের প্রশ্ন, ‘‘একের পাপে অন্যের সাজা পাওয়া কবে বন্ধ হবে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy