তিনি এক জন চিত্র পরিচালক। আবার তাঁর দেশের সামরিক শাসন-বিরোধী গেরিলা শিল্পী-যোদ্ধাও বটে। তাই কলকাতায় এ বার তাঁর ছবি দেখানো হলেও নামটা বলা যাবে না। সামরিক জুন্টা-শাসিত মায়ানমারের সেই ‘নামহীন’ চলচ্চিত্রকার তাঁর ছবির শো উপলক্ষে ইউরোপের অজ্ঞাতবাস থেকে আসছেন।
আগামী কাল, বৃহস্পতিবার উত্তম মঞ্চে কলকাতা পিপল্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল শুরুর প্রাক্কালে সেই খবরে দারুণ উত্তেজিত সংগঠকেরা। মায়ানমারের ছোট্ট ছবি ‘কমরেড পুপি’ কলকাতা দেখবে রবিবার এই চলচ্চিত্র উৎসবের শেষ সন্ধ্যায়। পুপি কিন্তু একটি বেড়াল। সামরিক শাসনে ঘরছাড়া হয়ে প্রতিরোধকারী গেরিলাদের শিবিরের খোঁজ করছেন ট্রাভেল ভ্লগার এক দম্পতি। তাঁদের অনিশ্চয়তা ও সঙ্কটের জীবনে ফুরফুরে মুক্তির বাতাস পুপি নামে ওই মার্জার বন্ধুটি।
সরকারি বা বেসরকারি, কোনও রকম পৃষ্ঠপোষকতাহীন কলকাতা পিপল্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এক দশকের বেশি এ শহরের বার্ষিক পার্বণ। গোড়ার দিকে প্রেক্ষাগৃহে জনা পঞ্চাশেক দর্শক থেকে উপচে পড়া ভিড়েরও সাক্ষী। সমমনস্ক জনসাধারণের উৎসাহেই মূল ধারার বিনোদন ক্ষেত্রের বাইরের নানা ছবি, তথ্যচিত্র সম্ভার নিয়ে এ সিনে-ভোজ ফিরে ফিরে আসে। উদ্যোক্তা পিপল্স ফিল্ম কালেক্টিভের তরফে কস্তুরী বসু বলছিলেন, “আমাদের দেশের ছবি তো বটেই, মায়ানমার, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার কিছু ছবিও এ বার খুব গুরুত্বপূর্ণ।” বাস্তবিক এক ধরনের দক্ষিণ এশীয় যন্ত্রণার ঐক্য একাকার এই ছক-ভাঙা সিনে-অঙ্গনে। বৃহস্পতিবার সকালে প্রথম ছবিটিরই নাম— ‘পিজিয়নস অব লাহৌর’। গ্রিক পরিচালক টমাস সিদেরিসের ছবি পাকিস্তান থেকে দেশান্তরী হয়ে গ্রিসে দিশেহারা এক ঝাঁক নর-নারীর জীবনে নানা বিপর্যয়ের বিষাদগাথা।
গত এক বছরে রাজনৈতিক পালাবদলের সূত্রে নজরকাড়া বাংলাদেশের ছবিও এই উৎসবের পুরোভাগে। বাংলাদেশের প্রবীণ শিক্ষাবিদ, গবেষক মেঘনা গুহঠাকুরতার একটি ইচ্ছাপূরণ হচ্ছে ‘জ্যোতির্ময়’ ছবিটির মাধ্যমে। ‘জ্যোতির্ময়’ মানে মেঘনার বাবা জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক তথা জগন্নাথ হলের প্রোভস্ট জ্যোতির্ময় ঢাকায় ২৫ মার্চ, ১৯৭১-এর গণহত্যায় মৃত্যুবরণ করেন। দেশভাগের পরে পাকিস্তানকে স্বদেশ হিসাবে বেছে নেওয়া মাস্টারমশাই জ্যোতির্ময় এই উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার উদারমনা অসাম্প্রদায়িক সত্তারই প্রতীক।
আর একটি ছবি ‘তৃতীয় ভুবন’ যে ছবির বিষয় হয়ে উঠতে পারে, তা হয়তো কয়েক বছর আগেও কেউ ভাবতেন না। দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের 'অচলায়তন' নাটকটির মঞ্চায়নের সুবাদে বন্ধু হয়েছেন মেলবোর্নে প্রবাসী দুই বাংলার কয়েক জন। উপমহাদেশের বিদ্বেষ-রাজনীতির অচলায়তনের বিরুদ্ধেই যা স্পর্ধায় রুখে দাঁড়ায়। ছবিটির পরিচালক শঙ্খজিৎ বিশ্বাস, বিশ্বজিৎ মিত্র।
রাজনীতির জটিলতায় আজকাল কাছে থেকেও বড়ই দূরের বা দুর্গম দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি। সংখ্যালঘু, প্রান্তিকদের জীবনযাপনও তাঁদের মিলিয়ে দিচ্ছে। গুরুগ্রামে খোলা মাঠে শুক্রবারের নমাজ পড়তে মুসলিমদের বাধা দিচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীর দল। তাঁদের বলা হচ্ছে, অফিসের ব্যস্ত সময়ে শহরের অন্য প্রান্তের মসজিদে যেতে হবে। রৌনক চোপড়া, দেবাংশী যাদবের ছবি ‘নো স্পেস টু প্রে’ যেন এক বদলানো, ভ্রষ্ট ভারত-আত্মার ছবি। উৎসবের শেষ দিনে সুরবাহার শিল্পী, মার্গসঙ্গীত আচার্যা অন্নপূর্ণা দেবীকে নিয়ে ‘সিক্স এ আকাশগঙ্গা’ ছবিটিও কি এক ধরনের বঞ্চনা বা বৈষম্যেরই আলেখ্য নয়? রবিশঙ্কর-জায়া অন্নপূর্ণা ও তাঁর শিষ্য নিত্যানন্দ হলদিপুর নিজেরাও এ ছবিতে রয়েছেন। জনতার উৎসবে ৩৮টি ছবির সম্ভারে দৃশ্যমান জীবনের আলো-অন্ধকার।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)