বাড়ির দাওয়ায় বসেছিলেন বছর চল্লিশের আজিজুল হক। সামনে দাঁড়িয়ে পাড়ার জনা পাঁচেক বন্ধু।
বেলা এগারোটার মেটিয়াবুরুজ। রাস্তার পিচ গলানো গনগনে রোদের উত্তাপ যেন আরও বেড়েছে ভোট গণনার আঁচে। ঘরে-ঘরে, দোকানে-দোকানে টিভি চলছে, তাতে ফলাফল নিয়ে বিশেষজ্ঞদের নিরন্তর চুলচেরা বিশ্লেষণ। আক্রা রোডের ধারের আড্ডাটিতেও তা-ই। দেশ জোড়া নির্বাচনের ফল কাটাছেঁড়া করে আজিজুল রায় দিলেন, “পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুরা একজোট হয়ে বিজেপি-কে আটকে দিতে পেরেছে। অন্য জায়গায় সংখ্যালঘু ভোট ভাগ হয়ে গিয়েছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন বাকিরা।
মেটিয়াবুরুজ-খিদিরপুর-গার্ডেনরিচ কিংবা রাজাবাজার-পার্ক সার্কাস-কলুটোলার মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মহল্লায় শুক্রবার এমনিতেই দিন শুরু হয় একটু দেরিতে। বিকেলে জুম্মার নমাজের আগে দোকানপাটও বিশেষ খোলে না। তার উপরে এ দিন দুপুরে রোদ-ভোটের যুগল চাপে পথ-ঘাট কার্যত শুনশান। শুধু কিছুটা দূরে দূরে কোনও সেলুন বা চায়ের দোকানে টিভি ঘিরে বিক্ষিপ্ত জটলা, মৃদু কথাবার্তা। বিচালিঘাটের কাছে এমনই এক সেলুনের সামনে আলোচনায় তাল কাটল বছর বারোর ইকলাখের স্লোগান। সাড়ে তিন বছরের ভাই আজিজকে এক হাতে কোলে ধরা, অন্য হাতে ঠান্ডা পানীয়ের টেট্রা প্যাক। নাচতে নাচতে ভাইকে শেখাচ্ছে, “বোল না, অব কি বার, মোদী সরকার!”
সেলুনের দরজায় আসতেই মাথায় চাঁটা। টেলিভিশন থেকে চোখ সরিয়ে নাসির ধমক দিলেন, “চুপ কর। এখানে ও-সব নেই।” তার পরে টিভির ফের পর্দায় চোখ রেখে আক্ষেপের সুরে বললেন, “সিরফ মেহঙ্গাইনেই (মূল্যবৃদ্ধিই) কংগ্রেস কো মার দিয়া!”
কলুটোলার তামিজুল হক-মহম্মদ শওকত হোসেন-হাজি মহম্মদ মহসিনদেরও অভিমত অনেকটা তা-ই। শাসকদলের মার্কামারা সদস্য না-হলেও ওঁরা এ বার তৃণমূলের হয়ে প্রচার করেছিলেন। মহল্লায় মহল্লায় বৈঠকী সভা করে ভোটারদের আবেদন জানিয়েছিলেন, তৃণমূলকে ভোট দিন। স্বভাবতই সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ে ওঁরা খুশি। “এখন মানুষ কাজ আর নিরাপত্তা চায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সেটাই পাওয়া গিয়েছে। ফল মিলেছে ভোটবাক্সে” মন্তব্য তামিজুলের। রাজাবাজারের মহম্মদ কাল্লু, আরিফ হোসেনরাও মানছেন, এ রাজ্যে তৃণমূলের সৌজন্যেই মোদী-ঢেউ আটকে দেওয়া গিয়েছে। এ দিন ওঁরাও বলছেন, “এখানে আমরা অনেক নিশ্চিন্ত। আশা করব, দিল্লির বিজেপি সরকার মানুষের মধ্যে শান্তি বজায় রাখবে।”
কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম নিরাপত্তার আশ্বাসে ভর করে সংখ্যালঘু এলাকায় জোড়াফুলের জয়জয়কার। তা সত্ত্বেও শাসকদলের সব মহল কি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত?
নেতাদের কারও কারও প্রতিক্রিয়ার অবশ্য কিছুটা সংশয়েরও ছোঁয়া। কলকাতা পুরসভার ডেপুটি মেয়র ফরজানা আলম তাঁদের এক জন। রাজাবাজার এলাকায় ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরজানা দুপুর দু’টো নাগাদ অধীর আগ্রহে ফোন করছিলেন গণনাকেন্দ্রে উপস্থিত দলীয় নেতাকে “আমার ওয়ার্ড কত ভোটে লিড দিল?” ও-প্রান্তের উত্তর, “ঊনিশশোর মতো।”
শুনে মুষড়ে পড়লেন ফরজানা। “জানেন, গত পুরভোটে আমি প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভোটে জিতেছিলাম! ২০১১-র বিধানসভায় মার্জিন ছিল সাত হাজার! এ বার এত কম!” বিস্মিত মন্তব্য তাঁর। ডেপুটি মেয়র জানালেন, “বুথওয়াড়ি ফল এলে দেখতে হবে, কোথায় ভোট কম পেলাম।” একই ভাবে বন্দর বিধানসভা এলাকার ‘লিড’ তথ্যও শাসকদলকে কিছুটা চিন্তায় রেখেছে। তৃণমূলের দুর্গ হিসেবে পরিচিত, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এ তল্লাটে তৃণমূল এগিয়ে রয়েছে মাত্র হাজার সাতেক ভোটে।
চিন্তার কারণ যে একেবারে অমূলক নয়, রাজাবাজার-পার্ক সার্কাসে ঘুরলে তা-ও যেন কিছুটা টের পাওয়া যাচ্ছে। রাজাবাজারের লতিফ হোসেন যেমন সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন, “তৃণমূল বা সিপিএম কেউই উন্নয়নের নিরিখে বাংলাকে গুজরাতের সমান বানাতে পারেনি। সিপিএম সাফ হয়ে গেল। মমতা তবু তিরিশের কোটায় আসন পেয়েছেন। কিন্তু তাতে কী! দিল্লিতে তো যেতে পারলেন না!”
শুধু নিরাপত্তা নয়। জোড়াফুলের কাছে মোদী-মডেলে উন্নয়নও চাইছেন লতিফের মতো সংখ্যালঘুরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy