Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

মেন্টরদের যাত্রাভঙ্গ করতে পা চালাচ্ছেন সুজনদা

বারুইপুর পূর্বে ১৮ হাজার ৪৭৯ আর পশ্চিমে ৩১ হাজার ৮৮৮। সোনারপুর দক্ষিণে ৩৭ হাজার ৭৭৪ আর উত্তরে ২৬ হাজার ২৪। যাদবপুরে ১৬ হাজার ৬৮৪, টালিগঞ্জে ২৭ হাজার ৬৮০। তিন বছর আগের বিধানসভা ভোটের এই হিসাব ধরলে ব্যবধান ১ লক্ষ ৫৮ হাজার ৫২৯! এক খণ্ড মরূদ্যান বলতে সে বার ছিল শুধু ভাঙড়। পাঁচ হাজার ভোটে জিতিয়ে তারা লাল পতাকার মুখ রক্ষা করেছিল। পঞ্চায়েত ভোটের পরে সে ভাঙড়ও তো আরাবুল ইসলাম, কাইজার আহমেদদের দখলে!

সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৪ ০৩:১৫
Share: Save:

বারুইপুর পূর্বে ১৮ হাজার ৪৭৯ আর পশ্চিমে ৩১ হাজার ৮৮৮। সোনারপুর দক্ষিণে ৩৭ হাজার ৭৭৪ আর উত্তরে ২৬ হাজার ২৪। যাদবপুরে ১৬ হাজার ৬৮৪, টালিগঞ্জে ২৭ হাজার ৬৮০। তিন বছর আগের বিধানসভা ভোটের এই হিসাব ধরলে ব্যবধান ১ লক্ষ ৫৮ হাজার ৫২৯!

এক খণ্ড মরূদ্যান বলতে সে বার ছিল শুধু ভাঙড়। পাঁচ হাজার ভোটে জিতিয়ে তারা লাল পতাকার মুখ রক্ষা করেছিল। পঞ্চায়েত ভোটের পরে সে ভাঙড়ও তো আরাবুল ইসলাম, কাইজার আহমেদদের দখলে!

তা হলে আর লড়াই কীসের? টালিগঞ্জের বিধায়ক এবং রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস যে বলছেন “ওটা এ বার দু’লাখ হবে”, তাকেই আপ্তবাক্য ধরে গা এলিয়ে থাকতে পারত তৃণমূল! ধরেই নেওয়া যেত, যাদবপুরে ঘাসফুল ফোটা শুধু সময়ের অপেক্ষা! ভবিতব্য ধরে নিয়ে ঘরে বসে যেতে পারত সিপিএমও! কিন্তু তা তো হচ্ছে না!

তিন বছর আগে পরিসংখ্যানের গদিতে গা ছেড়ে দিয়ে এ বারের ভোট পেরোনো যে মুখের কথা নয়, টের পাচ্ছে শাসক দল। বিধানসভায় ৩০ হাজারেরও বেশি ভোটে জেতা এক তৃণমূল বিধায়কের কথাতেই শোনা যাক। “সে ভোট আলাদা ছিল। তখন সরকারে পরিবর্তন আনতে মানুষ মনস্থির করে ফেলেছিল। পরের কয়েক বছরে কিছু ঘটনা ঘটেছে। না ঘটলে ভাল হতো। তার উপরে এখানে আমাদের যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রায় প্রতিটা বাড়ি ছুঁয়ে ফেলেছেন তিনি! তাই ঢিলে দেওয়ার প্রশ্ন নেই!” নেই বলেই সোনারপুর, বারুইপুরে টলিউড-টিভি সিরিয়ালের তারকা নামাতে হচ্ছে প্রচারে। নেই বলেই ভাঙড়ের আশেপাশে একটু বেচাল দেখলেই ‘শিক্ষা’ দিতে ছুটে যাচ্ছেন আরাবুলেরা! ফুরফুরা শরিফের পীর হোন আর যে-ই হোন, একই দাওয়াই! নেই বলেই সিপিএম, এমনকী কংগ্রেসের দেওয়াল লিখনের উপরে কোথাও কোথাও লেপে দিতে হচ্ছে ঘাসফুল। ক্ষমতায় আসার বহু আগে থেকেই তৃণমূলের উপরে সদয় থেকেছে যে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, সেখানেই গিয়ে মানুষের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!

কীসের ক্ষমা? সে তো তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ভূষণ! আসলে পাশের ডায়মন্ড হারবারের মতোই যাদবপুর কেন্দ্রেও গত বারের জয়ী সাংসদ বদলাতে হয়েছে তৃণমূলকে। সোমেন মিত্র যেমন তৃণমূল ছেড়েছেন, যাদবপুরের কবীর সুমন তেমন প্রায় আড়াই বছর ছিলেন তৃণমূলের নেটওয়ার্কের বাইরে। তৃণমূল নেত্রীকে তাই এখন বলতে হচ্ছে, “আমাদের ভুল হয়েছিল। ওঁদের আমরা বিশ্বাস করেছিলাম! আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।”

সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

প্রথম প্রথম সুমন-কাঁটায় অস্বস্তি ছিল। দলনেত্রী পরিষ্কার ভাবে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার পরে আর ও’সব ভাবছেন না। চশমায় আটকে যাওয়া ফুলের কুঁচো সরাতে সরাতে বলছেন নেতাজির নাতি। এ বার তৃণমূলের নতুন প্রার্থী। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্ডিনার অধ্যাপক। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন্টর গ্রুপের চেয়ারম্যান। সাংসদ হলে বুনিয়াদী শিক্ষা, শিশু ও মহিলাদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যের পরিষেবাই হবে যাঁর অগ্রাধিকার। “এই যে এত লোক এগিয়ে আসছে, কথা বলছে, অভিযোগ জানাচ্ছে, এ সব আমি আমার শিক্ষার অঙ্গ বলে ধরে নিয়েছি। যদি রাজ্যসভায় আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হতো, এই অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতাম।” বলছেন সুগত বসু। হার্ভার্ড-সুলভ স্যুট ছেড়ে যিনি আপাতত হুডখোলা জিপে সাদা কুর্তা-পায়জামা আর স্নিকার-ভূষিত। হাতের কর্ডলেস মাইক্রোফোন থেকে অনবরত ধন্যবাদ আর দিল্লিতে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গড়ার বার্তা বিলোচ্ছেন।

কুঁদঘাট, নিউ টালিগঞ্জ, পূর্ব পুঁটিয়ারি, বাঁশদ্রোণীতে তাঁর মিছিল দেখলে বিজয় মিছিল বলেই ভ্রম হয়! রণ-পা, ব্যান্ড পার্টি, তাসা, মা-মাটি-মানুষ লেখা টি-শার্ট, তাঁতের শাড়ি-হাওয়াই চপ্পল-মুখোশে শোভিত ‘মমতা’ কী নেই? সুগতের জন্য রাঙা ঘোড়া, ঢাল-তলোয়ার সব বন্দোবস্তই করে রেখেছেন মন্ত্রী অরূপ। রাস্তায় জিপ থামিয়ে মহিলাদের দঙ্গল মাঝেমাঝেই তাই এগিয়ে আসছে জোড়া মালা নিয়ে। প্রথম মালা সুগতের জন্য, পরেরটা নিশ্চিত ভাবে জিপে ঠিক তাঁর পিছনে দণ্ডায়মান অরূপের জন্য! যাদবপুরের শহরাঞ্চলে যিনি আসলে তৃণমূল প্রার্থীর মেন্টর। গত বার যেমন ছিলেন সুমনের জন্য। বাঁ হাঁটুতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ। তবু ফ্ল্যাটবাড়ির উপর থেকে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসা ফুলের পাপড়ি জিপ থেকে মুঠো মুঠো কুড়িয়ে নিয়ে মহিলাদের দিকে ভাসিয়ে দিচ্ছেন প্রেসিডেন্সির মেন্টরের ভোট-মেন্টর। “৩৬৫ দিন কাজ করে এ সব এলাকা হাতে নিয়েছি বাবা! অত সহজ নয়! একটা ভোটও বাইরে পড়বে না!” তৃপ্তির হাসি অরূপের মুখে।

সন্তোষপুরের রাজাপুর, মডার্ন পার্ক ধরে যে মিছিল ঢুকছে, তার সামনের লোকটার মুখেও হাসি। ‘অ্যাই প্রীতম, সুজনদা এসেছে’, বলতে গেলেন এক উৎসাহী সমর্থক। গৃহকর্তার ধমক ফেরত এল এক লহমায় “তুমি বলবে তার পর চিনব, নাকি?” ‘ও মানববাবু, এই যে সুজনদা’। চিহ্নটা মনে আছে তো? মৃদু গলায় প্রশ্ন ‘সুজনদা’র। বৃদ্ধের প্রতিক্রিয়া, “আসতে গেলে কেন?” মিছিল দেখে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে-পড়া সাইকেল আরোহিনী ছাত্রীর মাথায় চাঁটা পড়ল ‘সুজনদা’র। “বাবাকে বলিস, এসেছিলাম।” সলজ্জ মাথা নাড়ল কিশোরী।

পুঁটিয়ারিতে যিনি জিপের সওয়ারি ছিলেন, তিনি ‘সুগতবাবু’। সন্তোষপুর থেকে বারুইপুর পয়দল মিছিলে যিনি, তিনি ‘সুজনদা’। যাদবপুর থেকেই আগে সাংসদ হয়েছেন, হেরেওছেন। গলি, তস্য গলি, ফ্ল্যাটবাড়ির দো’তলায় কে, কার বাড়ির নীচে কে ভাড়া থাকে, সব নখদর্পণে। “ভাঙড়ের মতো কিছু এলাকা, যেখানে যাতায়াত একটু অসুবিধা এবং এলাকাও স্বাভাবিক নয়, সেটুকু ছাড়া বাকি সব জায়গায় আমি পায়ে হেঁটে। পার্সোনাল কমিউনিকেশন। সব পাড়ায় যাওয়া হয়তো হয়ে উঠবে না। কিন্তু সব পুরসভার প্রতিটা ওয়ার্ড আর গ্রামাঞ্চলে প্রতিটা গ্রাম পঞ্চায়েতে আমি ঢুকছিই।” বলছেন সুজন চক্রবর্তী। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সিপিএম জেলা সম্পাদক। সারদা থেকে টেট, সব প্রতিবাদে চেনা মুখ। জেলার যেখানেই দলের কর্মী-সমর্থকেরা আক্রান্ত, পৌঁছে যাবে তাঁর সাদা অ্যাম্বাসাডর। সাদা সুতির শার্ট, ঘন রঙের ট্রাউজার্স আর চটি গলিয়ে সাতসকালে সেই যে বেরোবেন, রাত সাড়ে ১২টাতেও তাঁর ফোন ‘বিজি’ মিলবে! আশ্চর্য নয় যে, তৃণমূল বিধায়ক এমন প্রতিদ্বন্দ্বীকে সমীহ করবেন!

ময়দানে আরও দু’জন আছেন। পরিবর্তনপন্থী থেকে প্রতিবাদী হয়ে ওঠা কংগ্রেস প্রার্থী চিত্রশিল্পী সমীর আইচ। আর রামকৃষ্ণ-সারদার ছবি নিয়ে বাঙালি আবেগে কড়া নাড়তে চাওয়া বিজেপি-র প্রার্থী, যাদবপুরের অধ্যাপক স্বরূপপ্রসাদ ঘোষ। আপাতদৃষ্টিতে যদিও মনে হচ্ছে যাদবপুরের লড়াইটা প্রকৃতপক্ষে সুগত বনাম সুজনই, তবু সম্মিলিত প্রশ্ন ধেয়ে আসছে সব শিবির থেকেই। প্রেসিডেন্সির মেন্টর, নেতাজি-পরিবারের কৃতী সন্তানের গ্রামীণ ভোট-মেন্টর কেন আরাবুলেরা? শিক্ষা জগৎ এতে কেমন গর্বিত? বাঁশদ্রোণীর এক তৃণমূল নেতা হাঁকিয়ে দিচ্ছেন, “এ সব আপনাদের মিডিয়ায় লেখা-টেখা হয়। হার্ভার্ড দিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ভোট হয় নাকি? যে খাবারের যা মশলা!”

স্বয়ং সুগত? পাড়ার দেওয়ালে ডিওয়াইএফআইয়ের ফিচেল পোস্টার বলছে, ‘নো বোকা বানাওয়িং’! সে দিকে ভ্রক্ষেপ না-করে চলমান জিপের হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে সুগত বলছেন, “নাঃ! আমি পরিষ্কার বলে দিয়েছি, আমার সঙ্গে থাকতে গেলে সভ্য, মার্জিত, বিনয়ী আচরণ করতে হবে। যাঁরা পারবেন না, থাকবেন না!” পীর-কাণ্ডের জেরে সংখ্যালঘু ভোট নিয়ে এমনিই চিন্তা আছে শাসক দলের। চাপ বাড়াতে বিরোধীরা আবার তুলে এনেছে প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ কৃষ্ণা বসুর লেখা ‘অ্যান আউটসাইডার ইন পলিটিক্স’-এর সেই অধ্যায়। যেখানে বিবরণ আছে গুজরাত দাঙ্গার পরে সংসদে তৃণমূল নেত্রীর বাজপেয়ী সরকারের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত কী ভাবে ব্যথিত করেছিল লেখিকাকে। “মা যেটা লিখেছেন, সেটা তো ইতিহাস। মা লিপিবদ্ধ করেছেন। ওই বইয়ে তৃণমূল নেত্রী সম্পর্কে অনেক ভাল কথাও আছে। কই সেগুলো নিয়ে তো কেউ কথা বলছেন না?” সবিনয় জানতে চাইছেন সুগত। সঙ্গে বলে রাখছেন, “মা যেটা চেয়েছিলেন, এ বার হবে। নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতায় আসা আমরা রুখে দেব!”

কিন্তু সুগতকে তিনি রুখবেন কী করে? পাহাড়-প্রমাণ লিড মেটাবেন কী করে? হাঁটতে হাঁটতেই হাসছেন সুজন, “সে ভোট আর এ ভোট এক নয়। লোকসভায় যাদবপুর আমরা হেরেছিলাম ৫৬ হাজারে। বিধানসভায় লোকে সরকারের পরিবর্তন চেয়েছিল বলে ব্যবধান ওই রকম হল। এখন মানুষকে বলছি, যে আশায় ভোট দিয়েছিলেন তৃণমূলকে, সে গুড়ে তো বালি! সারদা, টেট দুর্নীতি, পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানি দেখেও আবার এদের ভোট দেবেন? ঘরের ছেলেদের চাকরি নেই, মেয়েদের নিরাপত্তা নেই। আবার বিশ্বাস করবেন এদের?”

হরিণাভির মধ্যবিত্ত পাড়ায় সেই বৃদ্ধারও মনে ধরেছিল কথাটা। “মেয়েদের গায়ে হাত পড়েছে। ভোটটা দিতে যাতে যেতে পারি, সেইটে তোমরা দেখো বাবা!” বলেছিলেন বৃদ্ধা। নমস্কার সেরে এগিয়ে পড়েছিলেন সিপিএম প্রার্থী।

‘ও সুজনদা, একটু আস্তে চলো না!’ ডাক আসছিল পিছন থেকে। “আয়, আয়! সময় নেই।

পরে কথা বলিস!” পা চালালেন ‘কমরেড সুজনদা’! অনেক দূর যেতে হবে তাঁকে!

অন্য বিষয়গুলি:

sandipan chakraborty loksabha election jadavpur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE