Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

ভরসার আসনেও নিশ্চিন্ত হতে নারাজ বক্সীদা

তৃণমূলের মক্কা কোথায়? ক্লাস ফাইভের পড়ুয়াও এক বারে উত্তর দেবে, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট। সেই হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের অবস্থান দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে। এখান থেকেই পরপর সাত বার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলের এর চেয়ে নিশ্চিত আসন কী-ই বা হতে পারে?

অত্রি মিত্র
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৪ ০২:৩৬
Share: Save:

তৃণমূলের মক্কা কোথায়?

ক্লাস ফাইভের পড়ুয়াও এক বারে উত্তর দেবে, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট।

সেই হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের অবস্থান দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে। এখান থেকেই পরপর সাত বার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলের এর চেয়ে নিশ্চিত আসন কী-ই বা হতে পারে?

“রাজনীতিতে কোনও আসনই নিশ্চিত নয়। ২০০৪ সালে এখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেড় লক্ষ ভোট কমেছিল” ঝাঁঝালো উত্তরটা রাজ্যের কোনও বিরোধী নেতার নয়। খোদ দক্ষিণ কলকাতার তৃণমূল

প্রার্থী সুব্রত বক্সীর। দলের অন্দরে, এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর সামনেও যিনি ‘পষ্ট কথায় কষ্ট নেই’ ধাঁচের মানুষ হিসেবেই পরিচিত।

তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “এখনও দিদিকে তাঁর দলের প্রথম তিন জন নেতার নাম করতে বললে বক্সীদার নাম থাকবেই। অথচ, বাকিদের মতো প্রচারের আলোয় থাকেন না বক্সীদা।” হয়তো সেই জন্যই মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর দক্ষিণ কলকাতার মতো নিশ্চিত লোকসভা আসন মমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন সুব্রত বক্সীকেই।

‘দিদি’র ডাকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া সুব্রতবাবুর নিজের কথায়, “আমার কী আছে! পেনশন আছে। কোনও নেশা নেই। তেমন পিছুটানও নেই। দিদির ইচ্ছেয় তিন বার বিধায়ক হয়েছি। এক বার সাংসদ। দিদি না থাকলে জানতেই পারতাম না, আমাকেও পুলিশ বুক চিতিয়ে স্যালুট করতে পারে। আর কী চাই!”

এ হেন ৬৩ বছরের তরুণ তুর্কি সুব্রত বক্সী এখন দৌড়চ্ছেন। কখনও কসবার পিকনিক পার্কে, কখনও ভবানীপুরের উড়িয়াপাড়ায়, আবার কখনও বা চক্রবেড়িয়ায়। বক্তৃতায় হাজার বার বলছেন মমতার নাম। বলছেন, “আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গড় ছিল দক্ষিণ কলকাতা। এখন সারা বাংলাই তাঁর গড়।” কখনও বলছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লি থেকে বাংলার অধিকার আদায় করার জন্য লড়ছেন। তাঁর পিছনে বাংলার মানুষ রয়েছেন। সে জন্য তাঁর বিরুদ্ধে সবাই মিলে লাগাতার কুৎসা করছে।”

কুৎসার কথা বললে অবশ্য গলা ভারী হয়ে আসে কংগ্রেস প্রার্থী মালা রায়ের। ২০০৫ সালে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল হয়ে ঘড়ি চিহ্নে কলকাতা পুরসভায় লড়েছিলেন ৮৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে। জিতেওছিলেন। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির বাড়ির কাছেই নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে বললেন, “কুৎসার কথা ওঁদের মুখে মানায় না। আমাকে হারাতে মমতাদি সে বার শুধু এই ওয়ার্ডে ছ’টা সভা করেছিলেন। বাড়ির সামনে মাইকের মালা সাজিয়ে আমার নামে মমতাদি যা নয় তাই বলেছিলেন। আমার ছেলে আর মেয়ে তখন ছোট। তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সে দিনের কথা আমি কোনও দিন ভুলতে পারব না।” চোখ মুছে, ধাতস্থ হয়ে মালা বলেন, “মানুষ সে বার কুৎসার জবাব দিয়েছিল। মানুষের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। আমাকে তাঁরা ফেরাবেন না। কে বলতে পারে, এ বার দক্ষিণ কলকাতায় দুর্ঘটনা ঘটবে না!”

দুর্ঘটনা এড়াতেই তো দৌড়চ্ছেন সুব্রত বক্সী। আর দৌড়বেন না-ই বা কেন! খোদ হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটেও সিঁদ কেটে ঢুকে পড়েছেন তিনি নরেন্দ্র মোদী। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের একটু দূরেই সুব্রতবাবুর ফ্লেক্সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মোদীর পোস্টার। তাতে লেখা, ‘দেশ চায়... উন্নয়ন, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন’। রাস্তায় ঢোকার মুখে সরু চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে এক যুবকের সহাস্য মন্তব্য, “সারা দেশে মোদী-হাওয়া। আর এখানে থাকবে না!” মাটির ভাঁড়ে চা ঢালতে ঢালতে দোকানিও বলে ওঠেন, “এ বার লড়াই সেয়ানে-সেয়ানে।”

লড়াই যে সেয়ানে-সেয়ানে, তা বিলক্ষণ জানেন তৃণমূলের নেতারাও। তাই পথসভায় জনৈক তৃণমূল নেতা বলেন, “এখানকার জৈন সম্প্রদায়ের ভাইদের বলি, মাড়োয়ারি ভাইদের বলি, এখানে ঘর ঘর মোদী নয়, ঘর ঘর সুব্রত বক্সী।” আর মঞ্চে বসে তৃণমূলের ছাত্রনেতা হিসেব কষেন, “অনুপ্রবেশ নিয়ে মোদীর মন্তব্যে আমাদের পোয়াবারো। সংখ্যালঘুরা তো বটেই, পূর্ববঙ্গ থেকে আসা কেউই আর বিজেপিকে ভোট দেবেন না।”

এ সব শুনে বই-ঠাসা ছোট্ট ড্রয়িং রুমে বসে মুচকি হেসে পোড়খাওয়া তথাগত রায় বলেন, “এখন হাওয়া বদলে গিয়েছে। সেটা বুঝতে হবে।”

হাওয়া বদলের একটা অঙ্ক কিন্তু সত্যিই রয়েছে। যেমন, হাত চিহ্নের বাঁধাধরা ‘অনুগত’ ভোট এ বার আলাদা লড়ার সুবাদে কংগ্রেসের ঝুলিতেই যাবে। অন্য দিকে, ‘মমতার গড়’-এ সিপিএম শেষ বার যে ভোট পেয়েছে, নতুন করে তা-ও আর কমবে না। কিন্তু বেহালা, কসবা, বালিগঞ্জ, রাসবিহারীর শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভোট মোদী-হাওয়ায় এ বার তৃণমূল থেকে উড়ে আসতে পারে বিজেপির ঝুলিতে। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই গোত্রের দোদুল্যমান ভোটই বিপুল পরিমাণে গিয়েছিল তৃণমূলের ঝুলিতে।

কিন্তু অঙ্ক তো পরের কথা, বিজেপির তো কোনও সংগঠনই নেই। আপনিই বা কোথায়! সন্ধে হলেই তো টেলিভিশনের পর্দায়! সাবধানী তথাগত। বলেন, “সংগঠন দিয়ে এখন আর ভোট হয় না। মানুষই বিজেপিকে ভোট দেবে। আর টেলিভিশনে সবাই ডাক পায় না। আমি পাই। সেটাকে আমি নির্বাচনের প্রচারের কাজে লাগাই।”

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপিকা, সিপিএম প্রার্থী নন্দিনী মুখোপাধ্যায় অবশ্য সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছনোতেই বিশ্বাসী।

দক্ষিণ কলকাতায় সবুজ জোড়াফুলের বাগানে লাল পতাকা খুঁজতে হয় দূরবীন দিয়ে। গত ২০ বছরে এখানে সিপিএমের সংগঠন কোথাও বেড়েছে, এমন ‘অভিযোগ’ তাবড় সিপিএম নেতাও করেন না। ২০১১ সালে এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা আসনে তৃণমূল শুধু জেতেইনি, পাঁচটিতে ষাট শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। সেখানেই এ বার ‘অন্য লড়াই’ দেখছেন নন্দিনী। বলছেন, “একটা কেন্দ্র কারও শক্ত ঘাঁটি হতে পারে না। রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপরে নির্ভর করে। এলাকা পুনর্বিন্যাসের পরে দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রের মধ্যে আসা বেহালা, বন্দর এলাকায় এ বার অন্য চিত্র। এখানকার মানুষ ইউপিএ সরকারের জনবিরোধী নীতি আর তৃণমূলের নৈরাজ্য বর্জন করবে।”

দক্ষিণ কলকাতা জুড়ে তৃণমূলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সিপিএমের দেওয়াল লিখন আর রাস্তার ধারে লালঝান্ডা বাড়তি সাহস জোগাচ্ছে নন্দিনীকে। মোদী হাওয়া কতটা আছড়ে পড়ে, নিশ্চয়ই তার অঙ্কও কষছেন? ফুঁসে ওঠেন নন্দিনী, “আমরা অঙ্ক কষি না। সিপিএমই বিজেপিকে সর্বশক্তি দিয়ে ঠেকাতে চাইছে। বামপন্থীরা বরাবরই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তারা দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার লড়াই লড়েছে।

এ বারেও লড়বে।”

দুই মহিলা প্রার্থীর প্রচারের অনেকটা জুড়েই থাকছে গত তিন বছরে রাজ্যে বেড়ে চলা নারী নিগ্রহের ঘটনা। কাটোয়া, কামদুনি, পার্ক স্ট্রিট, লাভপুর। নন্দিনী বলেন, “ছোটবেলা থেকে আমরা জানতাম, কলকাতা মেয়েদের জন্য নিরাপদ। এখন আর তা নয়। মানুষ এর বিরুদ্ধে ভোট দেবেন।” মালা রায়ের বক্তব্য, “প্রশাসন এখন সরকারের ভৃত্য হিসেবে কাজ করছে। নির্যাতিতাদের অভিযোগই তো নেওয়া হচ্ছে না।” তথাগত এবং মালার আবার আক্রমণের লক্ষ্য সুব্রত বক্সীও। মালার দাবি, “উনি কোনও দিনই বাগ্মী নেতা নন। মাইনাস-মমতা ওঁর কিচ্ছু নেই।” আর তথাগতর বক্তব্য, “সাংসদ হিসেবে সুব্রতবাবুর উপস্থিতি মাত্র ৩২ শতাংশ। কোনও প্রশ্ন করেননি। একটা বিতর্কেও অংশ নেননি।”

সংযত সুব্রতর জবাব, “আমার সময়ে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিল লোকসভায় পেশ হয়েছে। সবগুলিতেই উপস্থিত ছিলাম। যাঁরা এ সব বলছেন, তাঁরা কখনও সংসদে গিয়ে বক্তব্য রাখার সুযোগ পাবেন না। ভগবানই সুযোগ দেবে না।”

ভগবান, নাকি মমতা নামক ছাতা? সুব্রত উত্তর দেন, “মমতার মতো নেত্রী, অভিভাবক পাওয়া সার্থক। প্রতি পদক্ষেপে সহকর্মীদের খবর রাখেন।”

মঞ্চ থেকে নেমে মানুষের ভিড়ে মিশে যান ‘বক্সীদা’।

সবিস্তার দেখতে ছবির উপর ক্লিক করুন...

অন্য বিষয়গুলি:

atri mitra election in kolkata south
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE