Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

একটাও কথা না বলে বেরিয়ে যান তো

বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল! গার্ডেনরিচের ধানখেতিতে সরু কানা গলির মুখে লেপটে ছিল যে ছেলেগুলো, তারাই পথ আগলে দাঁড়াল ঠিক এক হাত দূরে। আকাশে তখন দুপুরের গনগনে রোদ। রাস্তায় একটা কুকুরও নেই কোথাও। তারই মধ্যে ভাঙা বাংলায় ধেয়ে এল একের পর এক প্রশ্ন কে? কেন এসেছেন? কোথায় যাবেন? গার্ডেনরিচের ধানখেতিতে গাঢ় গোলাপী রঙের পাঁচ তলা বাড়িটা সারা বছরই জমজমাট।

মহম্মদ ইকবাল

মহম্মদ ইকবাল

অত্রি মিত্র
শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৪ ০৩:২৫
Share: Save:

বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল!

গার্ডেনরিচের ধানখেতিতে সরু কানা গলির মুখে লেপটে ছিল যে ছেলেগুলো, তারাই পথ আগলে দাঁড়াল ঠিক এক হাত দূরে।

আকাশে তখন দুপুরের গনগনে রোদ। রাস্তায় একটা কুকুরও নেই কোথাও। তারই মধ্যে ভাঙা বাংলায় ধেয়ে এল একের পর এক প্রশ্ন কে? কেন এসেছেন? কোথায় যাবেন?

গার্ডেনরিচের ধানখেতিতে গাঢ় গোলাপী রঙের পাঁচ তলা বাড়িটা সারা বছরই জমজমাট। সোমবার ভোটের দিনে এক রকম কপাল ঠুকেই সেই বাড়ির মালিকের খোঁজে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁর দেখা তো পেলামই না, উল্টে সেখান থেকে বেরিয়ে গার্ডেনরিচ ছাড়া ইস্তক এক দল ছায়ার নজরে আটকে গেলাম!

সঙ্গী চিত্র-সাংবাদিক বিশ্বনাথ বণিক। দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রের অধীন ওই বন্দর এলাকায় কেমন ভোট হচ্ছে, তা দেখার পেশাগত টানেই গাড়ি নিয়ে সাতসকালে পৌঁছে গিয়েছিলাম গার্ডেনরিচে। ভেবেছিলাম, নতুন জমানায় এখানে ভোটের রশি যাঁর হাতে, তাঁর সঙ্গে এক বার দেখা করি।

মুন্নাভাই কোথায়, জানেন? আয়রন গেটের ফুটপাথে দাঁড়ানো এক মধ্যবয়স্ক এই প্রশ্ন শুনে মনে হল আকাশ থেকে পড়লেন! “কে মুন্নাভাই? এ নামে তো এখানে কেউ থাকে না” সটান জবাব তাঁর। চোখে পড়ল, হাত কুড়ি দূরে তৃণমূলের বড় পতাকা টাঙিয়ে বসে আছেন জনা চারেক যুবক। এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলাম, মুন্নাভাই কোথায়, জানেন? পাল্টা প্রশ্ন? “কে মুন্নাভাই?” বললাম, “মহম্মদ ইকবাল, তৃণমূলের বরো চেয়ারম্যান ছিলেন।” এ বার মুচকি হাসলেন এক তৃণমূল কর্মী। বললেন, “আজকের দিনে মুন্না সাহাবকে পাওয়া যায় নাকি? এলাকার দায়িত্ব তো তাঁর কাঁধেই।”

কিছুটা হতাশ হয়ে ফিরে আসছি, হঠাৎই একটা ছেলে পাশে সেঁটে গেল, “মুন্না ধানখেতিতে আছে। চলে যান। কাউকে মুন্নার কথা বলবেন না। বলবেন, ধানখেতিতে যাব।”

গেলাম ধানখেতি। দূর থেকে নজর কাড়ছে গোলাপী রঙের অট্টালিকা। বাড়ির পাশে এক ফালি জমিতে বিরাট সামিয়ানা। সেখানে ৪০-৫০টা চেয়ার এলোমেলো অবস্থায় বসে। সামিয়ানার তলায় খাবলা খাবলা জটলা কুড়ি থেকে আঠাশ বছরের শ’খানেক ছেলের। পরে শুনলাম, এরাই গার্ডেনরিচে মুন্নাভাইয়ে শক্তির আধার!

কাছে পৌঁছেই একটা শিরশিরানি যেন গোটা গা বেয়ে নেমে এল। দূর থেকে আমাদের দেখতে পেয়ে এক দল ছুটে এল। শুরু হল জবাবদিহি-পর্ব। কিন্তু চোখ তো খুঁজে বেড়াচ্ছে মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নাভাইকে। হরিমোহন ঘোষ কলেজে পুলিশ কর্মী তাপস চৌধুরী খুনের পরে রাতারাতি শিরোনামে উঠে আসা তৃণমূল কাউন্সিলর। (হরিমোহন ঘোষ কলেজের বুথে এ দিন কিন্তু ভোট হয়েছে শান্তিতেই)। তাঁকে দেখলামও। জটলার পিছনের দিকে একটা বড় চেয়ারে গা এলিয়ে বসে তিনি। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট। গালে ক’দিনের না কামানো সাদা খোঁচা দাড়ি। আরাম করে চোখ বুজে কান চুলকোচ্ছেন।

এগোবো কি না ভাবছি। হঠাৎ ২০-২৫ জন যুবক ঘিরে ফেলল আমাদের। “কী চাই, কাকে চাই?” বললাম, “মুন্নাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাই।” এক যুবকের উত্তর এল, “উনি বিজি আছেন। এখন দিখা হবে না। চলে যান।” তবু যদি একবার কথা বলেন প্রশ্নটা শেষ করতে পারলাম না। জবাব এল, “বলাই তো হল, দিখা হবে না। এখুনি চলে যান। আর দাঁড়াবেন না। একটাও কথা না বলে বেরিয়ে যান।”

চলে এলাম। মানে আসতেই হল। কয়েক ঘণ্টা আগে, মানে গার্ডেনরিচে পা রাখা ইস্তক এই কথাগুলোই তো শুনতে হচ্ছে বারবার। পাহাড়পুর রোডে হরিবাবুপল্লির গাঁধী হিন্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ১০টা নাগাদ পৌঁছতেই ঘিরে ধরল এক দল ছেলে। তাদেরই একজন, স্থানীয় তৃণমূল নেতা গোরাচাঁদ মিত্র ওরফে গোরাদা বললেন, “শুনুন এখানে আমরা পিসফুল ভোট করছি। আপনারা চলে যান। না হলে ফল ভাল হবে না।” হুমকি দিচ্ছেন? জবাব এল, “হুমকির ভাষা অন্য। সেটা বলতে বাধ্য করবেন না। বলছি তো, একটাও কথা না বলে চলে যান।”

আসতেই হল। পাহাড়পুর রোডে দুপুরের দিকে তৃণমূলের এক কর্মী বলছিলেন, দিনভর নিজের ডেরা থেকেই ১৩৪ আর ১৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভোট-কন্ট্রোল করেছেন মুন্নাভাই। আর মোটরবাইকে চড়ে ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা ‘ম্যানেজ’ করেছেন তৃণমূলের কাউন্সিলর রঞ্জিৎ শীল। মুন্না-রঞ্জিৎদের এলাকায় পুলিশ তো দূর, কেন্দ্রীয় বাহিনীও যেন ভয়ে ভয়ে ঘুরছে! ফতেপুর সেবা সমিতি স্কুলে যেমন কেন্দ্রীয় বাহিনীর সামনেই তিন-চার জন তৃণমূল কর্মী এক যুবককে মারতে মারতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পরে জানা গেল, ওই যুবকের নাম মিঠুন দে। সিপিএমের পোলিং এজেন্ট। তাঁকে এক তৃণমূল কর্মীর হুমকি, “৩৪ বছর অনেক দেখেছি। এ বার আমরা করব।” আচমকাই ওঁদের চোখ গেল আমাদের দিকে। দুই যুবকের প্রতি নির্দেশ এল, “নজর রাখ। বেচাল দেখলেই ফোন করবি। বুঝে নেব।”

ততক্ষণে ‘বুঝে’ নেওয়াটা বুঝে গেছি আমরাও। তাপস চৌধুরীর ঘটনাটা এত টাটকা...!

অন্য বিষয়গুলি:

atri mitra md ikbal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE