ফেরা: গাড়ির অপেক্ষায় তরুণী। বৃহস্পতিবার রাতে, প্রিন্স আনোয়ার শাহ কানেক্টরে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
রাত সাড়ে দশটা পেরিয়ে গিয়েছে। দেশপ্রিয় পার্ক সংলগ্ন রাস্তা ধরে একা হাঁটছিলেন বছর সাতাশের রিয়া দত্ত। দু’টি মোটরবাইকে ছ’জন পিছু নেয় তাঁর। আশপাশে চক্কর কেটে এগিয়ে গিয়ে ফের পিছনের দিকে এসে একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়ায় একটি বাইক। উড়ে আসে নানা মন্তব্য। ঘটনাটি অবশ্য শুধু মন্তব্যেই শেষ হয়নি। একটি বাইকের কয়েক জন রিয়ার কাঁধের ব্যাগ ধরে টানাটানি শুরু করে। তিনি বাধা দিলে ধস্তাধস্তি আর নখের আঁচড়ে হাতের বেশ কিছুটা অংশ ছড়ে যায় রিয়ার। রাস্তায় পড়েও যান তিনি। স্থানীয় চায়ের দোকানের কয়েক জন চলে আসায় কোনও মতে বেঁচে যান ওই তরুণী।
বৃহস্পতিবার প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড এবং উদয়শঙ্কর সরণির সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে রিয়া যখন সেই রাতের কথা বলছিলেন, তখনও ঘড়ির কাঁটা পৌনে ১১টা ছুঁইছুঁই। ক্রমশ ফাঁকা হতে থাকা রাস্তায় শুধু কয়েকটি অটো দাঁড়িয়ে। রিয়া বললেন, ‘‘একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে কাজ করি। রোজই বাড়ি ফিরতে রাত সাড়ে দশটা-এগারোটা হয়। সে দিনের পর থেকে খুব ভয় হচ্ছে।’’ তরুণীর অভিযোগ, ‘‘সমস্যায় পড়লে কাকেই বা ডাকব? রাস্তায় তো সে ভাবে পুলিশও থাকে না।’’
চলতি সপ্তাহেই রাতের শহরে প্রাক্তন মিস ইন্ডিয়া ঊষসী সেনগুপ্তকে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ। পুলিশের কাছে গিয়ে জানালেও তাঁকে সাহায্য করা হয়নি বলে ঊষসীর দাবি। এর পরেই রাতের শহরের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠে যায়। অনেকেরই প্রশ্ন, আর পাঁচটি মেট্রো শহরের মতো কলকাতাতেও চাকরি সূত্রে অনেককে রাত করে বাড়ি ফিরতে হয়। তাঁদের জন্য কি কোনও নিরাপত্তার ব্যবস্থাই থাকবে না? আর্থিক কারণে অ্যাপ-ক্যাব নিতে পারেন না তাঁদের অনেকেই। বাস, ট্রেন বা শেষ মেট্রোই তাঁদের ভরসা।
বৃহস্পতিবার রাতে শহর কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণে ঘুরে দেখা গেল, ঊষসীর ঘটনার পরে কিছুটা সক্রিয় হয়েছে পুলিশ। জায়গায় জায়গায় নাকা তল্লাশির পাশাপাশি সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়ালে সিভিক ভলান্টিয়ারেরা খাতা-পেন হাতে গিয়ে জানতে চাইছেন, গাড়িটি কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাবে? ঊষসী যেখানে হেনস্থার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ, সেই এক্সাইড মোড়েও পুলিশি বন্দোবস্তের কড়াকড়ি। কলকাতা পুলিশের ডিসি (উত্তর) দেবাশিস সরকার এবং ডিসি (দক্ষিণ) মিরাজ খালিদ জানিয়েছেন, প্রতিটি ডিভিশনে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ কিয়স্কে রাতে পুলিশকর্মীরা নজরদারিতে থাকেন। সেই সঙ্গে মোটরবাইকে টহলদারির পাশাপাশি প্রতি ডিভিশনে অন্তত চারটি করে রেডিয়ো ফ্লাইং স্কোয়াড (আরএফএস) এবং বেশ কয়েকটি হেভি রেডিয়ো ফ্লাইং স্কোয়াডের (এইচআরএফএস) গাড়ি ঘোরাফেরা করে। রাতে প্রতি ডিভিশনে নজরদারি চালান এক জন করে ইনস্পেক্টর স্তরের পুলিশ আধিকারিক। যদিও বৃহস্পতিবার রাতে এক্সাইড বা হাজরা মোড়ে পুলিশি বন্দোবস্ত থাকলেও ধর্মতলা, গিরিশ পার্ক, শোভাবাজার, হাতিবাগান এবং উল্টোডাঙায় দেখা গেল, সেই পুরনো, নিয়ম না মানার চিত্র।
ওই রাতে গিরিশ পার্ক মেট্রোর বাইরে ট্যাক্সির অপেক্ষায় থাকা সেক্টর ফাইভের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী স্নেহা দত্তবণিক শোনাচ্ছিলেন এমনই পুলিশহীন রাস্তায় হেনস্থার কথা। কয়েক দিন আগে গড়িয়ার এক রেস্তরাঁয় বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলেন তিনি। রাত ১১টা নাগাদ সেখান থেকে বেরিয়ে অ্যাপ-ক্যাব বুক করেন। তবে ছ’মিনিট পেরিয়ে গেলেও ক্যাব আসেনি। চালক ফোনও ধরেননি। এর পরে ওই ক্যাব বাতিল করে নতুন করে ক্যাব বুক করেন তিনি। এ বার চালক পৌঁছলেও তিনি দাবি করেন, স্নেহারা যেখানে যেতে চাইছেন, সেই পথে যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁর বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। তাই ‘হোম লোকেশন’ করে রেখেছেন। এর পরে ওই ক্যাবও ছেড়ে অন্য ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে হয় স্নেহাদের।
সেই সময়েই মোটরবাইকে যাওয়া পাঁচ জনের একটি দল তাঁদের ঘিরে ধরে বলে অভিযোগ। নানা কটূক্তি চলতে থাকে। প্রতিবাদ করলে স্নেহার বন্ধুকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। তরুণীর কথায়, ‘‘কোনও মতে রেস্তরাঁর লোকজন আমাদের একটা হলুদ ট্যাক্সি ডেকে তুলে দেন। সাহায্যের জন্য কোনও পুলিশ ছিল না।’’
বাইপাসের একটি শপিং মলের কর্মী নবরূপা হালদার আবার বলছিলেন, ‘‘শুধু রাতে কেন, দিনেও নিরাপদ নই আমরা। বড় কেউ হেনস্থার শিকার হলে পুলিশ ক’দিন ঘটা করে কাজ করে। তার পরে সব আগের মতো! নিরাপত্তার পাকাপাকি ব্যবস্থা কোথায়?’’
কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা অবশ্য রাতের শহরে কম পুলিশকর্মী থাকার কথা মেনে নিয়েই নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন। ভোটের সময়ের মতো নাকা তল্লাশিও শুরু করতে বলেছেন বলে জানাচ্ছে লালবাজার। তবে তা চলবে কত দিন? রাতের শহরের নিয়ম না মানার পুরনো চিত্রটাই ফিরবে না তো?
স্পষ্ট উত্তর অবশ্য দিতে পারছেন না পুলিশ-প্রশাসনের কেউই।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy