Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

শব্দতাণ্ডব নিয়ে কেন কারও হেলদোল নেই

এ-ও প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে ছোটখাটো নানা ঘটনায় নাগরিক সমাজ আন্দোলনে মুখর হয়, সেখানে শব্দদূষণ নিয়ে বা বাজি ফাটানো নিয়ে নাগরিক সমাজের বৃহৎ অংশের কেন কোনও হেলদোল নেই? তা হলে কি তাদের একটি অংশ এটাকে অপরাধ বলে মনে করে না?

তটস্থ: বাজির তীব্র আওয়াজে স্থায়ী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে শ্রবণশক্তি। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

তটস্থ: বাজির তীব্র আওয়াজে স্থায়ী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে শ্রবণশক্তি। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

দেবাশিস ঘড়াই
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৯ ০০:৪৫
Share: Save:

শব্দবাজি, ডিজে, উচ্চগ্রামে মাইক কি নাগরিকদের একাংশের শুনতে না চাওয়ার অধিকার কেড়ে নেয়?

দু’দশকেরও বেশি আগে এ প্রশ্ন তুলেছিল কলকাতা হাইকোর্ট। ১৯৯৬ সালে একটি ধর্মীয় সংগঠনের মাইক্রোফোন ও লাউড স্পিকার ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে করা একটি মামলার রায়ে প্রয়াত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় এমনই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন। বিশেষত দু’টি শব্দবন্ধ ‘ক্যাপটিভ লিসেনার’ অর্থাৎ শব্দের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে পড়া এবং ‘ফ্রিডম টু রিমেন সাইলেন্ট’ বা চুপ করে থাকার অধিকার/ নৈঃশব্দ্যের অধিকার নিয়ে রীতিমতো শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরিবেশকর্মীরা জানাচ্ছেন, ওই রায়ের প্রায় ২৩ বছর পরেও পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। এক পক্ষের বাজি ফাটানোর উল্লাস যে ভাবে অন্য পক্ষের নৈঃশব্দ্যের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, সাংবিধানিক ক্ষমতাকে খর্ব করছে, তা নিয়ে আক্ষেপ করেছেন তাঁরা।

এ-ও প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে ছোটখাটো নানা ঘটনায় নাগরিক সমাজ আন্দোলনে মুখর হয়, সেখানে শব্দদূষণ নিয়ে বা বাজি ফাটানো নিয়ে নাগরিক সমাজের বৃহৎ অংশের কেন কোনও হেলদোল নেই? তা হলে কি তাদের একটি অংশ এটাকে অপরাধ বলে মনে করে না? বর্তমানে শব্দদূষণ নিয়ে যা কিছু আন্দোলন, তা বিক্ষিপ্ত ভাবে হচ্ছে। শব্দবাজি বা দূষণের বিরুদ্ধে সমবেত স্বর এখনও শোনা যায়নি। কিন্তু যত ক্ষণ না কালীপুজো বা দীপাবলিতে দূষণ নিয়ে সমবেত প্রতিবাদ হবে, তত ক্ষণ পরিস্থিতি বিন্দুমাত্র পাল্টাবে না বলেই জানাচ্ছেন পরিবেশকর্মীরা। এক পরিবেশকর্মীর কথায়, ‘‘বিষয়টা শুধুই যে আর পরিবেশ আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই তা সকলকে বুঝতে হবে। দূষণ সামগ্রিক ভাবে যে জায়গায় পৌঁছেছে, সেখানে এটা এখন সকলের মানসিক, শারীরিক স্বাস্থ্যের বিষয়। এই ক্ষতি সকলের।’’

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য বলছে, গত বছরই কালীপুজো, দীপাবলিতে শহরের ‘অ্যাম্বিয়েন্ট নয়েজ’-এর মাত্রা ১৫ ডেসিবেল বেড়ে গিয়েছিল শুধুমাত্র বাজি ফাটার কারণে। আইনজীবী ও পরিবেশ আইন বিশেষজ্ঞ গীতানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি একদা শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণে কলকাতা হাইকোর্ট নিযুক্ত স্পেশাল অফিসারও ছিলেন, তিনি জানাচ্ছেন, শব্দবাজি বা উচ্চগ্রামের যে কোনও শব্দ মানুষের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করে। তাঁর কথায়, ‘‘এক দিকে যেমন আমরা শব্দের ঘেরাটোপে আটকে পড়ি, না শুনতে চাইলেও শব্দবাজির আওয়াজ জোর করে শুনতে হয়, তেমনই আমাদের নৈঃশব্দ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। বছরের পর বছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে।’’

তার কারণ, নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশ এই বাজি ফাটানোর মধ্যে কোনও অপরাধ দেখে না। এমনটাই মনে করছেন থিয়েটারকর্মী সোহিনী সেনগুপ্ত। সোহিনীর কথায়, ‘‘যে বাজি ফাটানোর প্রতিবাদ করে, সে-ও হয়তো আতসবাজি পোড়ায়। শহরের বায়ুদূষণের যেখানে এই অবস্থা, এত মানুষের ফুসফুসে সমস্যা, সেখানে আতসবাজিও কিন্তু সমস্যার কারণ। এখানে সকলেই দোষী।’’ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের আবার বক্তব্য, নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ করলেও যত ক্ষণ না বাজি তৈরি বা তা বিক্রি বন্ধ করা যাচ্ছে, তত ক্ষণ এ সমস্যা মিটবে না। শীর্ষেন্দুবাবুর কথায়, ‘‘আমার বাড়ির অলি-গলিতেই বাজি ফাটে। বাজি ফাটিয়েই পালিয়ে যায়। কে ধরবে? যত ক্ষণ না ভিতর থেকে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, তত ক্ষণ কিছু করা যাবে না।’’

কিন্তু সে সচেতনতা কি আদৌ তৈরি হবে?

পরিবেশকর্মী নব দত্ত বলছেন, ‘‘অন্যের নৈঃশব্দ্যের অধিকার খর্ব হচ্ছে, তা বুঝতে এত বছর সময় লাগে না কি! আসলে আর সচেতনতা নয়, কড়া শাস্তি চাই। বছর বছর অনেক সচেতনতার প্রচার হয়েছে, তাতে কোনও লাভ হবে না। পুলিশ প্রশাসনের কড়া পদক্ষেপই একমাত্র পথ।’’

কিন্তু সে পথের দিশা কি এ বারেও মিলবে? মর্যাদা পাবে কি নৈঃশব্দ্যের অধিকার?—সংশয়ী সকলেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Sound Pollution Noise Kalipuja 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy