প্যাকেজের দর মতো দিতে হবে দুই থেকে দশ লক্ষ টাকা! অথচ, পাসপোর্টের আবেদনে লাগে ১৫০০ টাকা! —প্রতীকী চিত্র।
এক প্যাকেজেই হয়ে যাচ্ছে সমস্তটা!
সীমান্ত পার করানো। ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র হিসাবে জন্মের নকল শংসাপত্র বানানো বা বয়সের প্রামাণ্য নথি হিসাবে নকল আধার কার্ড তৈরি করানো। এর পরে ইন্টারভিউ দেওয়ানো। এবং সব শেষে আসল ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে ভারতেই থেকে যাওয়া বা বিদেশে পাড়ি! অভিযোগ, ‘প্যাকেজ দাদা’রাই করে দেবেন সব ব্যবস্থা। শুধু প্যাকেজের দর মতো দিতে হবে দুই থেকে দশ লক্ষ টাকা! অথচ, পাসপোর্টের আবেদনে লাগে ১৫০০ টাকা!
এত টাকা দিতে না পারলে আছে অন্য ব্যবস্থাও। সে ক্ষেত্রে নিজের দেশের পাসপোর্ট নিয়েই ঢুকতে হবে ভারতে, বা নিজেকেই করতে হবে সীমান্ত পারাপারের ব্যবস্থা। তবে এর পরে যা প্রয়োজন— যেমন ভারতীয় পাসপোর্টের জন্য নথি, পারিবারিক পরিচিতি দেখাতে বাবা-মা ভাড়া করা, পাসপোর্টের আবেদন থেকে ইন্টারভিউয়ে উতরে দেওয়া, সমস্তটাই দেখে নেবেন দাদারা। এ ক্ষেত্রে খরচ পাঁচ থেকে ছ’লক্ষ টাকা। নকল আধার ও ভোটার কার্ডের মতো নথির ব্যবস্থা করে পাসপোর্টের আবেদন করে দিতে হলে কাজ হবে এক লক্ষ টাকায়। আর শুধুই নকল নথির জন্য কয়েক হাজার টাকা খসালেই হল।
নকল নথির ভিত্তিতে আসল পাসপোর্ট বানিয়ে দেওয়ার চক্রের কয়েক জনকে গ্রেফতারের পরে পুলিশি তদন্তে এমনই তথ্য উঠে আসছে বলে সূত্রের খবর। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন লালবাজারের বড় কর্তা থেকে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্তারা। সূত্রের খবর, দিন কয়েক আগে ডাকঘর সেবা কেন্দ্র থেকে আসা কিছু আবেদন দেখে সন্দেহ হয় আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্তাদেরই। তাঁরা লালবাজারের দ্বারস্থ হন। সূত্রের খবর, আবেদনগুলি নকল নথির ভিত্তিতে করা হয়েছিল বলে ধরা পড়ে। সেগুলি ফের পুলিশের কাছে তথ্য যাচাইয়ে (ভেরিফিকেশনে) পাঠানো হয়। এর পরেই কলকাতা পুলিশ বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করে। তদন্তকারীরা জানতে পারেন, টাকা দিতে পারলেই এ দেশের পাসপোর্ট হাতে আসছে অনায়াসে। হাসপাতাল থেকে পুর প্রশাসকের দফতরে যোগাযোগ তৈরি করা থাকছে। ভিতরের লোকেরা টাকার ভাগের বিনিময়ে জন্মের নকল শংসাপত্র এবং নানা জরুরি নথি তুলে দিচ্ছে চক্রের হাতে। তার ভিত্তিতেই ডাকঘর পাসপোর্ট সেবা কেন্দ্র থেকে আবেদন করা হচ্ছে পাসপোর্টের। সেবা কেন্দ্রের দুই কর্মীকে গ্রেফতারের পরে পুলিশ দেখছে, ভিতরের লোক জড়িত থাকায় কোনও নথিই খতিয়ে দেখা হয়নি। পুলিশের তথ্য যাচাইয়েও ধরা পড়েনি।
সূত্রের খবর, শুধু কলকাতা থেকেই গত এক মাসে ৩০০০ এমন পাসপোর্ট তৈরি হয়েছে। ২০০-র বেশি পাসপোর্ট নিয়ে ইতিমধ্যেই ভারতীয় নাগরিক হিসাবে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে অনেকে। প্রশ্ন উঠছে, মুদির দোকান বা সিমকার্ড বিক্রির দোকানের আড়ালে অন্য নথিও জাল করার অভিযোগ সামনে আসছে প্রায়ই। কিন্তু কেন করা হয় না কড়া পদক্ষেপ?
খোঁজ করে জানা গেল, মূলত ঠিকানা এবং ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ প্রয়োজন হয় পাসপোর্টের জন্য। অভিযোগ, বাইরে থেকে সীমান্তবর্তী জেলাগুলি দিয়ে ঢুকে ভাড়ায় থাকে অবৈধ পথে পাসপোর্ট তৈরি করতে চাওয়া লোকজন। ‘প্যাকেজ দাদারা’ জন্মের শংসাপত্র-সহ জাল নথি তৈরি করার জন্য কয়েকটি ফোটোকপির দোকান ঠিক করে রাখছে। সেখানে কেউ ভোটার কার্ড, প্যান কার্ডের ফোটোকপি করালে একটি প্রতিলিপি রেখে দেওয়া হচ্ছে। তাতে অন্য ব্যক্তির ছবি লাগিয়ে ফের ফোটোকপি করা হচ্ছে। কখনও আবার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল এবং পুর প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের মাধ্যমে তৈরি করানো হয় জন্মের শংসাপত্র। এর খরচ সাত থেকে আট হাজার টাকা। সেগুলির ভিত্তিতে আরও টাকা দিলে মেলে আধার কার্ড। কলকাতায় আবার এই নথির দর দুই থেকে তিন হাজার টাকা বলে অভিযোগ। চক্রের মাথারাই ব্যাঙ্কের নামে স্ট্যাম্প তৈরি করিয়ে বানিয়ে ফেলছে ভুয়ো পাসবইও। পরে সরাসরি ডাকঘরের পাসপোর্ট সেবা কেন্দ্রে এই সব ভুয়ো নথি দিয়েই করা হচ্ছে পাসপোর্টের আবেদন।
লালবাজারের এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, ‘‘পর্ণশ্রী এবং বসিরহাটের দু’জনকে গ্রেফতারের পরে দেখা যাচ্ছে, ডাকঘর সেবা কেন্দ্রেও লোক রয়েছে প্যাকেজ দাদাদের। এ কাজে টাকা পায় বলে তারা নথি পরীক্ষা করে না। আঞ্চলিক পাসপোর্ট সেবা কেন্দ্রে ধরা পড়লে ঠিক আছে, নয়তো ডাকঘর পাসপোর্ট সেবা কেন্দ্র থেকে এসেছে বলে সহজেই পাশ হয়ে যায়। পুলিশের তথ্য যাচাইয়েও কিছুই ধরা পড়ে না।’’ দেখা যাচ্ছে, আবেদনে যে ঠিকানা দেওয়া হচ্ছে, তার সঙ্গে পিন নম্বর মিলছে না। এক ব্যক্তিকে গ্রেফতারির পরে পুলিশ দেখেছে, উত্তর কলকাতার ঠিকানায় পিন নম্বর রয়েছে পর্ণশ্রীর। এক পুলিশকর্তার দাবি, ‘‘পোস্ট অফিসেও চক্রের লোক থাকছে। ঠিকানা না পেয়ে তার হাতেই পাসপোর্ট দিয়ে আসছেন পোস্ট অফিসের কর্মী। ওই ব্যক্তির থেকে চক্রের পাণ্ডার হাত ঘুরে পাসপোর্ট পান আবেদনকারী।’’
কিন্তু কারও পাসপোর্ট কি এ ভাবে যে কাউকে দেওয়া যায়? এক দালালের দাবি, ‘‘হাতে কিছু টাকা দিতে পারলে সবই সম্ভব।’’
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy