বিতর্ক: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ক্যালকাটা গ্যালারি। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
‘‘যুদ্ধে যারা জয়ী হয়, স্মৃতিসৌধ তো তাদেরই হয়। এ শহরে ব্রিটিশদের যে ইতিহাস রয়েছে, তারই তো একটি অংশ ক্যালকাটা গ্যালারি। সেটির পরিবর্তন অন্তত আমার কাছে সমর্থনযোগ্য নয়।’’ বলছিলেন বর্ষীয়ান ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়। প্রেক্ষিত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে যে ‘ক্যালকাটা গ্যালারি’ রয়েছে, তার পরিবর্তনের দাবি ও সেই সংক্রান্ত ঘটনাপ্রবাহ।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ‘ক্যালকাটা গ্যালারি’-র উদ্বোধন হয়েছিল সেই ১৯৯২ সালে। তখনও কলকাতা হাইকোর্টের রায় বেরোয়নি। ২০০৩ সালে যে রায়ে বলা হয়, জোব চার্নক কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা নন। ব্রিটিশদের আসার আগেও এ শহরের অস্তিত্ব ছিল। নিজস্ব জনপদ ছিল। ফলে ‘ক্যালকাটা গ্যালারি’-তে জোব চার্নকের কলকাতায় আসা ও তার পরবর্তী কলকাতার গড়ে ওঠার ইতিহাসই ধরা রয়েছে।
কিন্তু সেই ইতিহাস নিয়েই আপত্তি উঠেছে। যা গড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর পর্যন্ত। কারণ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীন। সেখান থেকে তা গিয়েছে রাজভবনে। এর আবার কারণ, রাজ্যপাল ভিক্টোরিয়ার ‘বোর্ড অব ট্রাস্টি’-র চেয়ারম্যান। আপত্তিটি হল, ‘ক্যালকাটা গ্যালারি’-তে বড্ড বেশি ঔপনিবেশিকতার ছাপ। সেখানে ভারতীয়দের অবদানের উল্লেখ প্রায় নেই-ই। এই মর্মেই প্রধানমন্ত্রীর দফতরে গত সেপ্টেম্বরে অভিযোগ জানিয়েছে শহরেরই একটি সংস্থা। সেই সংস্থার প্রশ্ন, কী ভাবে সরকার এখনও ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসকেই একমাত্র বিবেচ্য মনে করতে পারে?
প্রধানমন্ত্রী শহরে আসার ঠিক আগের দিন, শুক্রবারই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সংস্থা ‘সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদ’-কে লিখিত ভাবে জানিয়েছে, গ্যালারি সংস্কারের পরে কলকাতা হাইকোর্টের রায় মেনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন হবে।
পরিষদের তরফে দেবর্ষি রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘ব্রিটিশদের আসার আগেও কলকাতার অস্তিত্ব ছিল। ২০০৩ সালে কলকাতা হাইকোর্টের রায়েও এটা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নক নন। তা সত্ত্বেও ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস কী ভাবে থাকতে পারে?’’ দেবর্ষি জানান, ভারতীয়দের এবং কলকাতা গড়ে ওঠার পিছনে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারেরও যে অবদান রয়েছে, তা ‘ক্যালকাটা গ্যালারি’-তে অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন জানানো হয়েছে।
সেই সঙ্গে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ শোয়েও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে। তবে এই দাবি কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন ইতিহাসবিদদের একটি অংশ। যেমন, ইতিহাসবিদ রজতকান্তবাবু জানাচ্ছেন, শহর হিসেবে কলকাতা কিন্তু ব্রিটিশদের হাতেই তৈরি হয়েছে। কারণ, তার আগে কলিকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি গ্রাম থাকলেও ব্রিটিশ রাজের রাজধানী হিসেবেই কলকাতা বাড়তি গুরুত্ব পায়। বর্তমানের কলকাতার গড়ে ওঠা কিন্তু ব্রিটিশদের হাত ধরেই। রজতকান্তবাবুর কথায়, ‘‘পলাশি যুদ্ধের আগে সিরাজউদ্দৌলা যখন শহরটা দখল করেছিলেন, তখন এর নামকরণ করেছিলেন আলিনগর। সেই আলিনগর নামটাই থেকে যেত, যদি না সিরাজ পলাশির ষড়যন্ত্রে মারা যেতেন। তা তো হয়নি। ক্যালকাটা গ্যালারি হল এ দেশে ব্রিটিশদের ইতিহাসের একটি অংশ। ফলে সেটি পরিবর্তন সমর্থনযোগ্য নয়।’’
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ অবশ্য বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিতে নারাজ। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, পুরনো গ্যালারিতে ব্রিটিশদের হাত ধরে কলকাতা জনপদ গড়ে ওঠারই উল্লেখ রয়েছে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কিউরেটর-সেক্রেটারি জয়ন্ত সেনগুপ্ত জানান, এটা বড় বিষয় নয়। নতুন ভাবে যখন ক্যালকাটা গ্যালারি তৈরি হবে, তখন সেখানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা হবে। লাইট অ্যান্ড শোয়ের স্ক্রিপ্টেও সেই মতো পরিবর্তন করা হবে। জয়ন্তবাবুর কথায়, ‘‘চারটি গ্যালারি সংস্কারের পরে নতুন করে উদ্বোধন করা হবে। আগামী রবিবার থেকে সংস্কারের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে ক্যালকাটা গ্যালারি। আশা করছি, আট-দশ মাস সময় লাগবে সেটি সংস্কার করতে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy