লকডাউনেও টান পড়েনি নেশার জোগানে। সল্টলেকে। নিজস্ব চিত্র
মানিকতলা খালপাড় লাগোয়া ফুটপাতে ডিম নিয়ে বসেছেন দুই মহিলা। খালি পা, উস্কোখুস্কো চুল। পরনের ময়লা পোশাক দেখে মনে হয়, এই দুর্দিনে খুব সমস্যায় পড়েছেন। একটু দাঁড়ালেই অবশ্য বদলাতে শুরু করে চিত্রটা। বোঝা যায়, ডিম নিয়ে বসাটা উপলক্ষ মাত্র। আদতে এ এক অন্য ব্যবসা!
কিছু সময় অন্তরই মোটরবাইকে কয়েক জন করে যুবক আসছেন ওই মহিলাদের কাছে। আর ডিমের বদলে তাঁদের হাতে ছোট ছোট প্যাকেট দিচ্ছেন মহিলারা। কীসের প্যাকেট? এক মহিলা বললেন, ‘‘তোমার কী দরকার? আগে তো কখনও দেখিনি। চেনা লোক ছাড়া ও জিনিসের খোঁজ দেওয়া বারণ আছে।’’
ওই মহিলাদেরই ‘চেনা লোকের’ সূত্রে জানা গেল, ভরা লকডাউনেও শহরে নেশার সামগ্রীর ব্যবসা বন্ধ নেই। বরং কার্যত নিত্য প্রয়োজনীয় জরুরি জিনিসের মতোই বেচা-কেনা চলছে তার। ফুটপাতে বসা দোকানি থেকে নানা হাত ঘুরে নেশার সামগ্রী পৌঁছে যাচ্ছে বাড়ি বাড়িও। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, তরল পানীয়ের দোকান বন্ধ থাকায় গাঁজা, চরসের পাশাপাশি এলএসডি ব্লট পেপার, মারিজুয়ানার মতো সিন্থেটিক ড্রাগের চাহিদাও বেড়েছে এখন। যে আস্তানাগুলিতে সেগুলি পাওয়া যাচ্ছে, তার আশপাশেই ফাঁকা জায়গা দেখে তৈরি হচ্ছে ‘নেশার হটস্পট’। কয়েক দিনে লাগাতার ধরপাকড় চালিয়েও সেই ঠেকগুলির সবক’টি ভাঙা যায়নি বলে দাবি কলকাতা পুলিশের গুন্ডাদমন শাখার এক কর্তার। এমনই এক নেশার ঠেক সংলগ্ন বাড়ির বাসিন্দা বললেন, ‘‘যে ঘিঞ্জি এলাকায় এই ঠেক বসে, সেখানে এই মুহূর্তে পুলিশের পক্ষেও ঢোকা সুবিধাজনক নয়। ফলে প্রায় বিনা বাধায় চলছে নেশার আসর।’’
আরও পড়ুন: বিঘ্ন যাত্রাতেও, শুরুই হয়নি মহরতের প্রস্তুতি
বাগমারি সেতুর ঠিক নীচের অংশে গিয়ে দেখা গেল, মাঝে মোমবাতি জ্বেলে গোল হয়ে বসে ছ’জন। মাস্কের বালাই নেই। সামনেই পড়ে একাধিক প্লাস্টিকের ফয়েল, এলএসডি-র ব্লট পেপার। কেউ মোমবাতির আগুনে প্লাস্টিক সেঁকছেন, কেউ ব্লট পেপার ছিঁড়ে জিভের নীচে রাখছেন। এখানে কী হচ্ছে? কথা বলার মতো অবস্থায় না থাকা এক যুবক খানিক জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, ‘‘এখানে রোজই বসি। কিছু হবে না।’’ পাশে বসা আর এক যুবকের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘আপনি কি ডাক্তার? মুখে মাস্ক দেখে মনে হল! এখানে করোনা নেই।’’
আরও পড়ুন: মুক্তিপণ চেয়ে ফোন, মিলল নিখোঁজ কিশোরের দেহ
শহরের পুরনো নেশার ঠেক পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশনের পিছনের ময়দানের অংশে জলাশয়ের পাশেই গাছের ছায়ায় বসে তিন জন। পাশে পড়ে শুকনো নেশার সামগ্রী। কোথায় থাকেন? এক যুবক জানালেন, পার্ক সার্কাস এলাকা থেকে হেঁটে এসেছেন। পুলিশ আটকায়নি? যুবক বলেন, ‘‘খাবার পাচ্ছি না বলেছি। ছেড়ে দিয়েছে।’’ গঙ্গার ঘাটগুলিতেও দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত দেদার নেশা চলছে বলে অভিযোগ। শশাঙ্ক মুখোপাধ্যায় নামে কুমোরটুলির এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘প্রতিদিন বিকেলে ঘাটের দিকে হাঁটতে যেতাম। এখন বন্ধ। লকডাউনের প্রথম দিকে কয়েক দিন গিয়েছিলাম, ওই জায়গাটা ছিনতাইবাজ, নেশাড়ুদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে।’’ একই রকম অভিযোগ ইএম বাইপাস লাগোয়া সোনালি পার্ক, শান্তি পার্ক সংলগ্ন এলাকা এবং টালিগঞ্জ রোডের বেশ কিছু বাসিন্দারও।
মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বলছেন, ‘‘প্রায় প্রতিদিনই রোগী দেখতে গিয়ে শুনছি, মূলত তিন রকমের ব্যাপার হচ্ছে। যাঁরা মদের সঙ্গে অন্য নেশার সামগ্রী নিতেন, তাঁরা এখন মদ না পেয়ে অন্য নেশার সামগ্রীর ব্যবহার বাড়িয়ে দিচ্ছেন। যাঁরা শুধুই মদ্যপান করতেন, তাঁরা খানিক বাধ্য হয়েই অন্য নেশা-দ্রব্যের দিকে ঝুঁকছেন। আর একঘেয়েমি, অবসাদ কাটাতে নেশাকেই একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নিচ্ছেন অনেকে। অন্য সময়ে তবু লড়া যায়, কিন্তু এই সময়ে এই ধরনের প্রবণতা মারাত্মক।’’
নার্কোটিক্স কন্ট্রোল বুরোর (এনসিবি) কলকাতা জ়োনের অধিকর্তা সুধাংশু সিংহ বলেন, ‘‘প্রতিদিন নানা জায়গায় হানা দিচ্ছি। তবে শুধু অপরাধী ধরাই নয়, সচেতন করে নেশামুক্তি ঘটানোও এনসিবি-র কাজ। এই মুহূর্তে সেই কাজকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা।’’ কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) শুভঙ্কর সিংহ সরকার বলেন, ‘‘ব্যাপারটি ইতিমধ্যেই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। নজরদারি আরও বাড়ানো হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy