যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ পাওয়ার পরে সাবধানেই পা ফেলতে চাইছিল কলকাতা পুলিশ। প্রথম ৪৮ ঘণ্টায় গ্রেফতার তো দূরের কথা, অভিযুক্ত পড়ুয়াদের সঙ্গে কথাও বলেননি তদন্তকারীরা। কিন্তু সোমবার সন্ধ্যায় হঠাৎই নড়েচড়ে বসল যাদবপুর থানা। পুলিশ জানায়, এ দিন সন্ধ্যায় গ্রেফতার করা হয় দুই অভিযুক্ত ছাত্রকে। পরে অবশ্য থানা থেকেই দু’জনকে ব্যক্তিগত জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক উৎসব চলাকালীন শুক্রবার রাতে এক ছাত্রীর ব্যাগ তল্লাশি নিয়ে বচসা হয়। ছাত্রীটি তিন ছাত্রের নামে যাদবপুর থানায় শ্লীলতাহানির অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ সূত্রের খবর, প্রকাশ্যে ওই ঘটনা ঘটলেও পড়ুয়াদের অধিকাংশই ঘটনাটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার এক দল ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়ে শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন। এ সব দেখেই পুলিশ সাবধানী হয়ে পড়ে। লালবাজারের এক কর্তার বক্তব্য, “তাড়াহুড়ো করে গ্রেফতার করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফের বড় ধরনের গোলমাল হতে পারত।” বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও অভ্যন্তরীণ তদন্তে তাড়াহুড়ো করতে চাইছিলেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানি ঘিরে গত সেপ্টেম্বরে পড়ুয়াদের আন্দোলনে লাঠি চালিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিল পুলিশ। শুরু হয়েছিল ‘হোক কলরব’ আন্দোলন। এ বার তাই সব দিক দেখেশুনেই এগোতে চাইছিল পুলিশ। লালবাজারের একাংশও ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, এ দিনের গ্রেফতারের ঘটনাও সাবধানী পদক্ষেপ। কী ভাবে?
পুলিশের ব্যাখ্যা, ওই ছাত্রীর যা অভিযোগ ছিল, তার ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। সোমবার সন্ধ্যায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হলে ব্যক্তিগত আইনজীবীর সাহায্যে তাঁরা জামিনের আর্জি জানান। অনেক ক্ষেত্রে জামিনযোগ্য ধারা হলেও পুলিশ জামিনের জন্য অভিযুক্তকে আদালতে পাঠায়। আবার পুলিশকর্তাদের নিজেদের বিচারবিবেচনার উপরে নির্ভর করেও জামিন দেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ দ্বিতীয় পন্থাই অবলম্বন করে। কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, “এই পথে ইঁদুরও মরল, আবার বাঁশও ভাঙল না!” গ্রেফতার হওয়ার আগে এ দিনই ওই দুই অভিযুক্ত ছাত্র একটি খোলা চিঠি দিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগের ‘সুষ্ঠু, পূর্ণাঙ্গ, নিরপেক্ষ এবং আইনি’ তদন্ত দাবি করেছিলেন।
এর আগে এ দিন দুপুরে কলা শাখার ছাত্র সংসদও যথাযথ তদন্তের দাবি তোলে। সন্ধ্যায় দুই ছাত্রের গ্রেফতার ও জামিনের পরে কলা শাখার ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শ্রমণ গুহ বলেন, “আমরা তো কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছি। দেখি তাঁরা কী করেন। আর গ্রেফতার প্রসঙ্গে এটুকুই বলব যে অভিযোগকারী ছাত্রী তাঁর বক্তব্য জানিয়েছিলেন, অভিযুক্তেরা তদন্তে সহায়তা করেছেন।” ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার ছাত্র সংসদের তরফে শুভব্রত দত্ত বলেন, “অভিযুক্তেরা ব্যক্তিগত ভাবে জামিন পেয়েছেন। এখানে সংসদের কিছু বলার নেই। তবে ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চাই আমরা।”
গত বছরও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছিলেন। জোর-কদমে তদন্ত ও অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবিতে তৎকালীন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে ঘেরাও করেছিলেন পড়ুয়ারা। আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ তাণ্ডব চালালে আন্দোলন বিশাল আকার নেয়। যার জেরে পদত্যাগ করতে হয় অভিজিৎবাবুকে।
সেই সময় তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন জুটা-র একটা বড় অংশ। গত শুক্রবারের ঘটনার প্রেক্ষিতে কেন জুটা সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে না, সোমবার সেই প্রশ্ন তুলেছেন আচার্য-রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। এ দিন সকালে রাজ্যপাল জানান, যাদবপুর নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা খুব ভাল নয়। তাঁর মন্তব্য, “আগের বার তো অনেক শিক্ষক আন্দোলন করেছিলেন। তাঁরা এখন চুপ কেন? এগিয়ে এসে অভিযুক্তদের আদালতে পেশ করছেন না কেন? কেনই বা অভিযুক্তদের ধরতে পুলিশকে সাহায্য করছেন না?”
গত বছর উপাচার্যের বিরোধিতায় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন জুটার সাধারণ সম্পাদক নীলাঞ্জনা গুপ্ত। সোমবার তিনি বলেন, “মাননীয় রাজ্যপালের বক্তব্যের উপরে কিছু বলতে চাই না। তবে আমরা এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরেই আস্থা রাখছি। আশা করছি, বিশ্ববিদ্যালয় এ নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ করবে। যদি দেখা যায় কিছু হচ্ছে না, তখন নিশ্চয়ই প্রতিবাদ জানানো হবে।” এ দিন বিকেলেই অভিযোগের তদন্তের দাবিতে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য আশিসস্বরূপ বর্মার সঙ্গে দেখা করেন নীলাঞ্জনাদেবী-সহ জুটার নেতারা। আশিসস্বরূপবাবুও তাঁদের যথাযথ তদন্তের আশ্বাস দিয়ে বলেন, “অভিযোগ যখন উঠেছে, তখন যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে, সব দিক দেখেই বিচার করা হবে।”
কিন্তু একের পর এক এ ধরনের অভিযোগ ও তার জেরে ক্যাম্পাসে তৈরি হওয়া অস্থিরতা যে সরকারকে মোটেই স্বস্তি দিচ্ছে না, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সোমবার কার্যত তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এ দিন সকালে তিনি বলেন, “সরকার কোনও ভাবেই এর মধ্যে ঢুকবে না।” দুই ছাত্র গ্রেফতার হওয়া ও জামিন পাওয়ার পরে অবশ্য আর শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য জানা যায়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy