লাড্ডুতে কামড়। নিজের দফতরে ‘ভাবী’ মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়।
সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলের ‘মর্যাদা’র দাবিতে বারবার সরব হয়েছেন তিনি। অতীতে বিধানসভায়, গত লোকসভা নির্বাচনের পরে সংসদে তাঁর দলকে প্রধান বিরোধী দলের প্রাপ্য মর্যাদা পাওয়ানোর জন্য কখনও তিনি দাবি তুলেছেন, কখনও বা চেষ্টা করেছেন অন্য কোনও দলের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্দিষ্ট সংখ্যায় পৌঁছতে। বিধানসভার ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন, কিন্তু লোকসভায় হননি।
সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলই এ বার কলকাতা পুরসভায় নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন না পাওয়ার যুক্তিতে বামেদের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। যার অর্থ, নবগঠিত পুরসভায় কোনও বিরোধী দলনেতা থাকবেন না। পাবেন না আলাদা ঘর বা আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা। বুধবারই বিরোধীদের ঘরে তালা দিয়ে দেওয়া হয়।
কেন এই ভাবনা? ‘ভাবী’ মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সংসদে এবং বিধানসভায় নিয়ম আছে, মোট আসনের ১০ শতাংশ না পেলে বিরোধী দলের মর্যাদা পাওয়া যায় না। আমরা তো সেই নিয়মের কথাই বলছি।’’ কিন্তু বামফ্রন্ট তো ১৫টি আসন পেয়েছে যা, পুরসভার মোট আসনের (১৪৪) ১০ শতাংশের শর্ত পূরণ করে। এই ফ্রন্ট ১৯৭৭ সাল থেকেই রয়েছে, তাই এটা কোনও নতুন বা ভোট পরবর্তী ফ্রন্ট নয়। সে ক্ষেত্রে সামগ্রিক ভাবে বামফ্রন্টকে বিরোধীর মর্যাদা দেওয়া হবে না কেন? নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যা ভিত্তি করে মেয়রের বক্তব্য, ‘‘বামফ্রন্ট বলে কমিশনের কাছে কারও স্বীকৃতি নেই। আছে, নিজ নিজ দলের নামে। যাদের কেউই একা ১৫টি আসন পায়নি। সুতরাং বিরোধী দলের মর্যাদা দেওয়ার কোনও কারণ নেই।’’
মেয়রের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। তৃণমূল যখন রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল ছিল, তখন ২৯৪ সদস্যের বিধানসভায় তাদের সংখ্যা এক সময়ে ৩০ এর নীচে নেমে যায়। ফলে বিরোধী দলের মর্যাদা পাওয়া নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়। কী করেছিলেন তখনকার স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম? হালিম বলেন, ‘‘ওঁরা অর্থাৎ, তৃণমূল তখন ২৯ ছিল। নিয়ম অনুযায়ী মর্যাদা পাওয়ার কথা ছিল না। তবে ওদের সম্মান দেওয়া হয়েছিল। ঘর দেওয়া হয়েছিল।’’ তিনি জানান, কংগ্রেস আমলেও জ্যোতি বসুকে বিরোধী দলনেতার সম্মান দেওয়া হয়েছিল। সে সময়ে বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে যে সংখ্যক সদস্যের প্রয়োজন ছিল, একক ভাবে জ্যোতিবাবুদের তা ছিল না। অন্য কয়েকটি দলের সঙ্গে নেতা হিসেবে জ্যোতিবাবুকে ওই সম্মান দেওয়া হয়েছিল। তবে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য প্রসঙ্গে হালিম সাহেবের বক্তব্য, ‘‘বামফ্রন্ট তো ভোটের আগে থেকেই একটি গ্রুপ। তাদের মর্যাদা দেওয়া উচি়ত। এটা যে কেন মানা হবে না, বুঝছি না। মেয়রের প্রতি বোধহয় উপরওয়ালার কোনও নির্দেশ রয়েছে।’’
একই যুক্তি প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যেরও। তিনি বলেন, ‘‘মেয়রের কথায় তো স্বৈরশাসকের কণ্ঠস্বর। একটা স্বীকৃত রাজনৈতিক দলকে মর্যাদা দিতে ওঁদের আপত্তি কোথায় বুঝতে পারছি না।’’ তিনি জানান, পুরসভায় এ নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট আইন নেই ঠিকই, তবে বহুকাল ধরে এই প্রথা পুরসভায় আছে। গণতন্ত্র রক্ষায় তা মানা উচিত।
২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের ‘মোদী ঝড়ে’ কংগ্রেস কার্যত মুছে যাওয়ার পরে ৫৪৩ সদস্যের লোকসভায় মোট সদস্য সংখ্যার ১০ শতাংশ হিসেবে ন্যূনতম ৫৫টি আসন পায়নি অন্য কোনও দলও। বিরোধী হিসেবে, কংগ্রেস একক ভাবে সর্বাধিক আসন পেলেও তা ৫০-এও পৌঁছয়নি। এই অবস্থায় লোকসভায় তারা বিরোধীর মর্যাদা হারায়। পরিস্থিতি আঁচ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছক কষেছিলেন যাতে জয়ললিতার দলের সঙ্গে জোট বেঁধে তৃণমূলের ৩৪ এবং জয়ললিতার ৩৯ মোট ৭৩টি আসন দেখিয়ে লোকসভায় বিরোধীর মর্যাদা হাসিল করা যায়। রাজনৈতিক কারণেই তা অবশ্য সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে এ সব ক্ষেত্রে ভোট পরবর্তী জোট মানার বিধি নেই। তাই লোকসভায় এখনও কোনও বিরোধী নেতা নেই। কিন্তু কলকাতা পুরসভায় কার্যত একই যুক্তিতে বিরোধী দলনেতা না রাখার ভাবনাকে কী চোখে দেখছে বিজেপি?
দলের নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলেন, ‘‘সংবিধানের নিয়মে লোকসভায় মোট আসনের ১০ শতাংশ না পেলে বিরোধী দলের মর্যাদা দেওয়া হয় না। তাই বর্তমান সরকার কংগ্রেসকে বিরোধী দলের মর্যাদা না দিলেও, বাকি সব সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু কলকাতার পুরসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল তৃণমূল বিরোধীদের সেই সম্মানও দিতে চায় না। ওরা গণতন্ত্র মানে না। স্বেচ্ছাচারী বলেই এমন করছে।’’
কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার মন্তব্য, ‘‘ভাবী মেয়র বিরোধী দলকে মর্যাদা না দিয়ে একটি নতুন নজির সৃষ্টি করতে চলেছেন।’’
কলকাতার মেয়র অবশ্য বিরোধী দলের মর্যাদা দেওয়া তো দূর অস্ত্, তাদেরকে ঘর পর্যন্ত দিতে নারাজ। আর সেই কারণেই বিরোধী দলের জন্য যে ঘরগুলো আগে দেওয়া হয়েছিল, সেখানে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। বুধবার কংগ্রেসের প্রকাশ উপাধ্যায় পুরনো ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখেন, সেখানে তালা ঝুলছে। পরে তিনি মেয়রকে বিষয়টি জানান। মেয়র অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, ওই ঘর তালা বন্ধই থাকবে। বিরোধী দলের মর্যাদা কেউ পাবে না। এমনকী, ঘরও দেওয়া হবে না। কারণ হিসেবে তাঁর যুক্তি, তৃণমূলের অনেক সদস্য। ১১৪ জন। ১২ জন মেয়র পারিষদ। চেয়ারম্যান, মুখ্য সচেতকদেরও তো জায়গা দিতে হবে।
বুধবার দুপুরে পুরভবনে ছবি দু’টি তুলেছেন প্রদীপ আদক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy