প্রচারের আলোয়: ধাপার জয় হিন্দ জলপ্রকল্প। ছবি: রণজিৎ নন্দী
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে কেন্দ্র করে বিরোধীদের রাজনৈতিক সমালোচনার জবাব দিতে এ বার কলকাতা পুরসভার ধাপার ‘জয় হিন্দ’ জলপ্রকল্পের উদাহরণ টেনে আনছেন রাজ্যের শাসকদলের নেতাদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন শাসকদল বা বিরোধীরা যতই দলকে নেতাজি-বিতর্কে বিদ্ধ করতে চাক না কেন, এর কোনও ভিত্তি নেই। কারণ, তাঁকে সম্মান প্রদর্শন বিরোধীদের রাজনৈতিক ‘কৌশল’-এর অঙ্গ হতে পারে। কিন্তু রাজ্যের শাসকদলের তরফে কখনওই সঙ্কীর্ণ রাজনীতির আঙ্গিকে তাঁর মতো ব্যক্তিত্বকে টেনে আনা হয়নি। যে কারণে ছ’বছর আগেই ধাপা জলপ্রকল্পের নামকরণ ‘জয় হিন্দ জলপ্রকল্প’ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা জানাচ্ছেন, এখন না হয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কলকাতা সফরে এসে ‘নেতাজি ভবন’ যাচ্ছেন বা সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর সূচনায় অনেক কর্মসূচি ঘোষণা করছেন। কিন্তু রাজ্যের শাসকদল তাঁকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য কোনও বার্ষিকীর অপেক্ষা করেনি। ওই নেতার কথায়, ‘‘সেটা করলে ২০১৪ সালে ধাপার জলপ্রকল্পের নামকরণ জয় হিন্দ জলপ্রকল্প হত না! মাঝেরহাট সেতুর নামও কিন্তু জয় হিন্দ সেতু-ই রাখা হয়েছে।’’ রাজ্যের শাসকদলের মুখপাত্র নির্বেদ রায়ের বক্তব্য, রাজনীতির ক্ষেত্র ধরেই সুভাষচন্দ্র বসু দেশকে স্বাধীনতার জন্য একটা উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে তাঁকে রাজনীতির মাধ্যমেই সব থেকে বেশি শ্রদ্ধা দেখানো সম্ভব। নির্বেদবাবুর কথায়, ‘‘তাই জলপ্রকল্পের নাম জয় হিন্দ দেওয়া বা নেতাজির মূর্তি স্থাপন বাংলার মানুষের কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা।’’ ২০১৪ সালে ওই জলপ্রকল্প উদ্বোধনের সময়ে ছিলেন মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। তাঁরও বক্তব্য, ‘‘নেতাজিকে সম্মান প্রদর্শন আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। সেই সূত্রেই ওই প্রকল্পের নাম জয় হিন্দ করা হয়েছিল।’’
যদিও ধাপা জলপ্রকল্পের নাম পাল্টে ‘জয় হিন্দ’ করার নেপথ্যে সেই ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধি’-ই দেখতে পাচ্ছেন বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য, বাম আমলে শুরু হওয়া ওই প্রকল্পের নাম প্রথমে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নামে ছিল। প্রকল্পের ফলক এখনও সেখানে রয়েছে। কিন্তু বর্তমান শাসকদল এসে নাম পরিবর্তন করে দেয়। যেমনটা বামেদের মন্ত্রিসভায় পাশ হওয়া ‘জ্যোতি বসু নগর’-এর নাম পাল্টে নিউ টাউন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শাসকদল। বাম পুর বোর্ডের আমলে কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, ‘জ্যোতি বসু জলপ্রকল্প’-এর নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হল আদতে ইতিহাসকে অস্বীকার করার প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ায় নেতাজির নাম যুক্ত করে তাঁকে অসম্মানই করা হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘নেতাজিকে সামনে রেখে রাজ্যের শাসকদল ইতিহাসকে অস্বীকার করার পদ্ধতিকে স্থায়িত্ব দিতে চেয়েছে এবং চাইছে। যা চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত।’’
সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর সূচনায় গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা বিজেপি নেতা চন্দ্রকুমার বসুর আবার বক্তব্য, ‘‘নেতাজিকে নিয়ে রাজ্য সরকারের ঘোষিত কর্মসূচিকে স্বাগত জানাচ্ছি। তবে তাঁকে সম্মান জানাতে গেলে তাঁর আদর্শকে সম্মান জানাতে হবে। নেতাজিকে নিয়ে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি করা উচিত নয়।’’ যার পরিপ্রেক্ষিতে তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় জানাচ্ছেন, বিষয়টি একদমই রাজনীতির নয়। কারণ, নেতাজি হলেন জাতীয় বীর। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য যে নিস্পৃহতা এ দেশে রয়েছে, তা পৃথিবীর কোথাও নেই। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্য সরকার তার সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও নেতাজিকে সম্মান জানানোয় উদ্যোগী হয়েছে।’’ যদিও শাসকদলের এই যুক্তি মানতে চাননি কংগ্রেস নেতা ঋজু ঘোষাল। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এখন কথায় কথায় সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রসঙ্গ টেনে আনছে রাজ্যের শাসকদল। কিন্তু নেতাজি, জওহরলাল নেহরু যে ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটা তো তারা সমূলে ধ্বংস করেছে!’’
ফলে সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে অনেকে মনে করছেন, ছ’বছর আগে প্রকল্পের নামবদল হলেও ‘জয় হিন্দ’ বিতর্ক এখনই থামার নয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy