আবেগ: বাংলার মনীষীদের নিয়ে হোর্ডিং কলকাতা পুরসভার। ফাইল চিত্র
আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে চলতি বছরেই পুর নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দল ও তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতিকেই ‘কৌশল’ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক-শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে বিদ্বজ্জনেদের একাংশ।
সাম্প্রতিক কলকাতা সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কলকাতা-সহ বাংলাকে আলাদা ভাবে তুলে ধরা থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায় সব বক্তৃতায় বাংলা সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া, সেই ‘কৌশল’-এরই অঙ্গ বলে মনে করছেন তাঁরা। কলকাতা পুরসভাও ইতিমধ্যে বাংলা ভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। রাস্তার নামফলকে বাংলার প্রাধান্যের পাশাপাশি পুরসভার বিজ্ঞাপন, শুভেচ্ছাবার্তা-সহ সমস্ত জায়গায় যাতে শুদ্ধ বাংলা বানান লেখা হয়, সে জন্য আলাদা কমিটিও তৈরি হয়েছে। ফলে বাংলা দিয়েই বাংলা জেতার একটা লড়াই শুরু হয়েছে দু’পক্ষের মধ্যে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর মতে, রাজনৈতিক নেতারা যে কোনও সময়েই চান যে তাঁদের সমর্থনের ভিত্তি বাড়ুক। সেই জায়গা থেকেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যে ভাবে বাংলা, বাঙালিকে দেখতেন, তার পুনর্নির্মাণ করতে চাইছে বিজেপি। উল্টো দিকে, গত বছর লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতার ধরন দেখলে বোঝা যাবে যে, ‘আমাদের বাংলা’, ‘বাংলার গৌরব’ কথাগুলি তিনি বারবার ব্যবহার করেছেন। বিশ্বনাথবাবুর কথায়, ‘‘বিজেপি-র হিন্দু জাতীয়তাবাদ আটকানোর জন্য রাজ্যের শাসক দল বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতির মাধ্যমে একটা উপজাতীয়তাবাদকে তুলে ধরতে চাইছে। কারণ, এক দিকে তৃণমূল চাইছে বিজেপিকে আবাঙালি দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। একই ভাবে বিজেপি চাইছে বাঙালিয়ানার মাধ্যমে বাংলায় নিজেদের সমর্থনের ভিত বাড়াতে।’’
আর এক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কথায়, ‘‘বিজেপি-র কাছে বাংলা এখন একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন ভাবে তৃণমূলের কাছে বাংলা ভোটারদের জনসমর্থন অটুট রাখাটাও একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ, গত লোকসভা নির্বাচনই দেখিয়েছে কী ভাবে উত্তর ও দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত কলকাতা পুরসভার অন্তত পঞ্চাশটি ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থীরা পিছিয়ে ছিলেন।’’
তবে বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতিকে যতই কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হোক না কেন, তাতে কোনওটিরই মানোন্নয়ন হবে না বলেই জানাচ্ছেন ভাষাবিদ পবিত্র সরকার। পবিত্রবাবুর কথায়, ‘‘বাংলা সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক কারণে যে ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা সাময়িক এবং ভীষণ ভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পুরোটাই ভোটের কথা মাথায় রেখে।’’
বিদ্বজ্জনেদের একাংশ আবার মনে করছেন, বর্তমান রাজনৈতিক আবহে বাংলা সংস্কৃতি ও ভাষা যে ভাবে আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে, তা কিছুটা অবধারিত ছিল। তার কারণ, বাংলা বা কলকাতায় বিজেপি-র রাজনৈতিক কোনও ভিত্তি নেই, সেটা বলার আর জায়গা নেই। শিক্ষাবিদ সৌরীন ভট্টাচার্যের মতে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলা সংস্কৃতির প্রয়োগ বাম আমলেই দেখা গিয়েছিল। গানমেলা, নাট্যমেলা, লিটল ম্যাগাজিন মেলা-সহ এ রকম নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সূত্রপাত সেই বাম আমলেই। বর্তমান শাসক দলের আমলে সেগুলোই আরও বেশি জাঁকজমকপূর্ণ, আরও বেশি প্রচার হচ্ছে। সে দিক থেকে দেখলে বিজেপি এই সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। সৌরীনবাবুর কথায়, ‘‘ভারতীয় জাদুঘরের সংস্কার, জাতীয় গ্রন্থাগারের বেলভেডিয়ার হাউস, মেটকাফ হল, ওল্ড কারেন্সি ভবন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের নতুন গ্যালারি-সহ নানা ভবন সংস্কারের প্রচার এবং আলাদা করে কলকাতাকে তুলে ধরা সেই ঘাটতি পূরণেরই একটি প্রচেষ্টা।’’ ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়ের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘বিজেপি আসলে হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান,—এই ফ্যাসিজ়মের ধারা তুলে ধরতে চাইছে। আর সেটাকে তুলে ধরতে গিয়ে বাংলা আবেগকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই ফ্যাসিজ়ম বাংলায় প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy