হতাশা: ছেলের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা বলতে বলতে ভেঙে পড়েছেন প্রীতম বেরার বাবা-মা এবং ভাই। নিজস্ব চিত্র
তিন মাস কেটে গিয়েছে, ছেলের খোঁজ মেলেনি। লালবাজার থেকে ভবানী ভবন— বারবার পুলিশের দ্বারস্থ হয়ে নাজেহাল বাবা ছেলের খোঁজে উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ে চড়েছেন। পাহাড়ি পথে লোক দেখলেই ছবি দেখিয়ে বলছেন, ‘‘এই আমার ছেলে। দেখেছেন?’’ আশার উত্তর মেলেনি। কলকাতায় ফিরে এসে এখন সেই বাবা ছেলের খোঁজ পেতে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছেন।
পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, ওই তরুণের খোঁজে যা যা করণীয় তা করা হয়েছে। ওই ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর ছেলের খোঁজে উত্তরাখণ্ডে গিয়েছিলেন বাঁশদ্রোণী থানার এক পুলিশ অফিসার। ওই থানাতেই গত ২৪ মে প্রীতমের নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়। এই ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে পুলিশ।
পুলিশ সূত্রের খবর, গড়িয়ার বাসিন্দা মেধাবী ছাত্র প্রীতম বেরা গত ২৩ মে দুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। সে দিন রাতে ছেলে বাড়ি না ফেরায় ২৪ মে সকালে বাঁশদ্রোণী থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন পেশায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপ বেরা। পরে ১ জুন অজ্ঞাতপরিচয়ের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা দায়ের হয় বাঁশদ্রোণী থানায়। যোধপুর পার্ক বয়েজ হাইস্কুলের কৃতী ছাত্র প্রীতম চলতি বছরে উচ্চ মাধ্যমিক ও জয়েন্টে এন্ট্রাস পরীক্ষায় ভাল ফল করেছে।
যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি থেকে বরাবর ভাল ফলাফল করে এসেছেন প্রীতম। মাধ্যমিকে নব্বই শতাংশের বেশি নম্বর ছিল তাঁর। চলতি বছরে জয়েন্ট ও আইআইটি প্রবেশিকায় ভাল ফলাফলও করেছিলেন তিনি।
বিভিন্ন ধরনের বই প়ড়া আর ছবি তোলার শখ ছিল প্রীতমের। যোধপুর পার্ক বয়েজ হাইস্কুলের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক চন্দন দাসের কথায়, ‘‘প্রীতম খুব ভাল ছাত্র। ওর নিখোঁজ হওয়ার কথা শুনে অদ্ভুত লাগছে। পুলিশ, প্রশাসনের কাছে আমাদের আর্জি, দ্রুত ওকে বাবা-মার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।’’
উত্তরাখণ্ডের বিষয়টি কী ভাবে সামনে এল? প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘৪ অগস্ট সকাল সাতটা দশ মিনিটে ছেলের মোবাইলে ফোন করতেই রিং হয়ে যায়। উত্তরাখণ্ড থেকে এক সাধু ফোন ধরে জানান, কেদারনাথের রাস্তার ধারে পড়ে থাকা ব্যাগ থেকে তিনি সিমটি পেয়েছেন। সেটি তিনি নিজের ফোনে জুড়ে দেন বলে ওই ব্যক্তি দাবি করেন।’’ ছেলের নম্বরে ফের ফোন করলে ফোনটি কেটে দেওয়া হয়। এর পরেই প্রদীপবাবু পুরো ঘটনাটি বাঁশদ্রোণী থানার ওসি-কে তৎক্ষণাৎ ফোন করে জানান, ছেলের সন্ধানে তিনি উত্তরাখণ্ড যেতে চান। প্রদীপবাবুর কথায়, ‘‘বাঁশদ্রোণী থানার ওসি আমাকে বলেন, পুলিশের তদন্তকারী দলকে এই মুহূর্তে উত্তরাখণ্ডে যেতে হলে উপর মহল থেকে অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু তা পেতে দেরি হবে ভেবে ছেলের স্বার্থে নিজের টাকায় বাঁশদ্রোণী থানার অতিরিক্ত ওসি-কে নিয়ে ওই দিন বিকেলেই বিমানে দিল্লি হয়ে গাড়িতে করে বদ্রীনাথে পৌঁছই।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, বদ্রীনাথে পৌঁছে পুলিশ সাধু শীতল দাসের ডেরা থেকে কাপড়, ব্যাগ ও আইআইটি পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড উদ্ধার করে। প্রীতমের ব্যবহৃত সিমটিও শীতলের থেকে বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। প্রীতমকে অপহরণের ঘটনায় গত সপ্তাহে বদ্রীনাথ থেকে শীতল দাস ও রবি দাস নামে দুই সাধুকে গ্রেফতার করে ট্রানজিট রিম্যান্ডে নিয়ে আসে বাঁশদ্রোণী থানার পুলিশ। তারা এখন পুলিশ হেফাজতে রয়েছে।
এ দিকে তিন মাস পরেও ছেলেকে ফিরে না পেয়ে বাঁশদ্রোণী থানার পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ করছেন প্রদীপবাবু। তাঁর অভিযোগ, ‘‘ছেলে নিখোঁজ হওয়ায় ২৪ মে পুলিশের কাছে অভিযোগ করি। অথচ প্রীতম বা়ড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে ৪ অগস্ট পর্যন্ত ফোনের বিল হয়েছে ১৬০০ টাকা। এর থেকেই স্পষ্ট যে ওর মোবাইল চালু ছিল। টাওয়ার লোকেশন পুলিশ আগে পরীক্ষা করলে ছেলেকে এত দিনে ফিরে পেতাম।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘৪ অগস্ট প্রীতমের মোবাইল ফোনে কথা বলতে পেরে আমিই পুলিশকে জানাই। ওর মোবাইল ফোন চালু রয়েছে কি না সে বিষয়ে আমাকে কেন পুলিশকে জানাতে হবে? কেন পুলিশই আগে সেই ব্যবস্থা নিল না?’’
রবিবার দুপুরে তিনতলার একচিলতে ফ্ল্যাটে ছোট ছেলে সংগ্রাম, স্ত্রী সৌরীমণিকে নিয়ে বড় ছেলের কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন প্রদীপবাবু। বলছিলেন, ‘‘পুলিশ সহায় থাকলে ছেলেকে ফিরে পাবই। আর দেরি না করে এ বার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যেতে চাই।’’
ডিসি (এসএসডি) সন্তোষ নিম্বলকর বলেন, ‘‘প্রীতমের সন্ধানে বাঁশদ্রোণী থানার তরফে যাবতীয় তল্লাশি চলছে। প্রীতমের বন্ধুদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।’’ প্রদীপবাবুর অভিযোগ প্রসঙ্গে ডিসি (এসএসডি) বলেন, ‘‘প্রীতমের মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন যাচাইয়ে কোনও গাফিলতি ছিল না। ফোন দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। চালু হতেই উত্তরাখণ্ডে পুলিশ পাঠানো হয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy