—প্রতীকী চিত্র।
মিথ্যার আশ্রয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন তিনি। মনে করেছিলেন, থানায় গিয়ে দাদাকে খুন করেছেন বললে অন্তত খুনের আসামি হিসাবে হাজতে থাকা যাবে। খাওয়া-পরা নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না! কিন্তু সেই মিথ্যে ধরা পড়ে যায়। যে পুলিশের কাছে ধরা দিতে গিয়েছিলেন তিনি, সেই পুলিশই তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে সমাজের মূল স্রোতে। হাজতে থাকার বদলে এখন চাকরি করেন ওই যুবক। বেতন থেকে টাকা বাঁচিয়ে তৈরি করতে চান নিজের সংস্থা। যাতে তাঁর মতো লোকজনকে দিতে পারেন কাজের সুযোগ।
যুবকের নাম শুভজিৎ চক্রবর্তী (নাম পরিবর্তিত)। বছর ছেচল্লিশের এই যুবক ২০২২ সালের জুন মাসে হঠাৎ খবরের শিরোনামে আসেন। বাঁশদ্রোণী থানায় গিয়ে শুভজিৎ দাবি করেন, দাদাকে বালিশ চাপা দিয়ে খুন করেছেন তিনি। শুভজিতের বাড়ি গিয়ে পুলিশ দেখে, বিছানার উপরে পড়ে আছে এক ব্যক্তির দেহ। বুকের কাছে একটি বালিশ। পাশে বাটিতে রাখা জল। জ্বরের সময়ে জলপট্টি দেওয়ার মতো করে ব্যবহার হওয়া রুমাল রাখা দেহের কপালে। কিন্তু পুলিশ চিন্তায় পড়ে, কাউকে বালিশ চাপা দিয়ে খুন করা হলে তিনি তো বাঁচার চেষ্টা করবেন। আশপাশে সেই চেষ্টার ছাপ থাকবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা নেই কেন?
শুভজিৎ দাবি করেন, বাবার মৃত্যুর পর থেকে মা এবং দাদাকে নিয়ে তিনি বাঁশদ্রোণীর নিরঞ্জনপল্লির একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতে শুরু করেন। বাবা এবং মায়ের পেনশনের টাকায় চলত তাঁদের সংসার। দাদা একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন। কিন্তু চোখের সমস্যা ধরা পড়ায় সেই কাজ থেকে অবসর নেন তিনি। সেই কাজের সূত্রে শুভজিতের দাদাও পেতেন সামান্য কিছু টাকা পেনশন। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পরে বাবা এবং মায়ের পেনশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুই ভাইয়ের অর্থকষ্ট চরমে ওঠে। পুরনো ফ্ল্যাট ছেড়ে নিরঞ্জনপল্লির একটি ছোট বেড়ার ঘর ভাড়া নিয়ে চলে আসেন তাঁরা। কিন্তু দাদার পেনশনে সেই সংসার চালানোও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শুভজিৎ দাবি করেন, তাঁর দাদা কিছু দিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু চিকিৎসা করানোর টাকা ছিল না। সেই হতাশা থেকেই তিনি দাদাকে খুন করেছেন।
কিন্তু দেহের ময়না তদন্তের রিপোর্ট এলে জানা যায়, খুন নয়, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যু হয়েছে শুভজিতের দাদার। তখন ওই যুবক দাবি করেন, কয়েক বছর ধরে তিনি বেকার। নিজের মৃত্যুর পরে ভাইয়ের কী ভাবে চলবে, এই ভেবে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। কারণ, তাঁর পেনশনের টাকাও বন্ধ হয়ে যাবে! তাই দাদাই নাকি ভাইকে বলেছিলেন, পুলিশের কাছে গিয়ে খুনের গল্প বলার কথা। কিন্তু শুভজিৎ অপরাধী নয় বুঝে তাঁকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। নাছোড় ওই যুবক থানার সামনেই বসে থাকতে শুরু করেন। বাঁশদ্রোণী থানার এক পুরনো অফিসার বলেন, ‘‘বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়, আমায় একটা কাজ দেখে দিন— এই বলে সারাক্ষণ থানার সামনে ঘুরতেন ওই যুবক। শেষে বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখার সিদ্ধান্ত হয়। যত দিন না পর্যন্ত ওই যুবকের জন্য ভাল কোনও কাজের ব্যবস্থা করা যায়, তত দিন তাঁকে দিয়ে থানায় কিছু কাজ করানো যায় কি না, দেখার নির্দেশ দেন পুলিশকর্তারা।’’
শুভজিৎ বাণিজ্যে স্নাতক। কম্পিউটারেও দক্ষ। তাই সিদ্ধান্ত হয়, থানার যে সব কাজে কম্পিউটার প্রয়োজন হয়, সেই কাজগুলি তাঁকে দিয়ে করানো হবে। ব্যারাকেই থাকবেন তিনি। শুভজিতের খাওয়ার ব্যবস্থা হয় থানার ক্যান্টিনে। থানার অফিসারেরাই টাকা দিয়ে তহবিল তৈরি করে দেন তাঁর খাওয়ার খরচ চালানোর জন্য। দ্রুত থানার ‘পুলিশ’ হয়ে ওঠেন শুভজিৎ। মামলা কম্পিউটারে তোলা থেকে অভিযোগকারীর বক্তব্য শুনে লিখে রাখার কাজও করতে থাকেন তিনি।
শুভজিৎ রবিবার বলেন, ‘‘বছরখানেক থানায় কাজ করার পরে থানার এক স্যর শিমুলতলায় এক বিচারপতির বাড়িতে কাজের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু লেখাপড়ার কোনও কাজ করতে চাইছিলাম আমি। এর পরে হাওড়ার একটি ওষুধের দোকানে কাজ পাই। এখন শরৎ বসু রোডে একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কাজ করছি।’’ ওই যুবক জানান, বেহালায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকার বন্দোবস্তও করে দিয়েছেন এক ব্যক্তি। মাসিক ১৭ হাজার টাকা বেতনের কাজে একার সংসার ভালই চলছে। এক সময়ে হাজতে থাকতে চাওয়া যুবক এখন বলছেন, ‘‘আমার মতোই অনেকে আছেন, যাঁরা হারিয়ে যান। তাঁদেরও যাতে ঠিক পথ দেখিয়ে কাজের বন্দোবস্ত করা যায়, এমন সংস্থা তৈরি করতে চাই নিজের হাতে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy