প্রতীকী ছবি।
অনুষ্ঠান করতে কলকাতা থেকে গাড়িতে চেপে মেদিনীপুর গিয়েছিলেন শিল্পী। রাস্তার ধুলোয় গলাবন্ধ হয়ে যায় তাঁর। একটির বেশি গান করতে পারলেন না। আয়োজক ও শ্রোতাদের সামনে সেই সমস্যার কথা ঘোষণা করে জানালেন, তাঁকে ছেড়ে দিতে। শ্রোতা কিংবা আয়োজক সেই ঘোষণাকে গুরুত্ব তো দিলেনই, শিল্পীও একটি গান গেয়েই ছাড়া পেলেন। এমনকি আয়োজকেরাও সেই শিল্পীর জন্য বরাদ্দ পুরো টাকা দিয়ে দিলেন।
ঘটনাটি বহু বছর আগের। গত মঙ্গলবার কলকাতায় সঙ্গীতশিল্পী কৃষ্ণকুমার কুন্নথের (কেকে) মৃত্যুর পরে এমন নানা গল্প শোনা যাচ্ছে কলকাতার বিভিন্ন আয়োজক ও শিল্পীমহল থেকে। মহম্মদরফি, কিশোরকুমার থেকে শান, সোনু নিগম, শ্রেয়া ঘোষালদের মতো শিল্পীদের রাজ্যে এনে দশকের পর দশক ধরে বিচিত্রানুষ্ঠান করানো আয়োজকেরা জানিয়েছেন, আগের সেই শ্রোতা কিংবা উদ্যোক্তারা শিল্পীদের শুধুই মনোরঞ্জনের উপাদান ভাবতেন না।
মেদিনীপুরে পৌঁছে গান গাইতে না পারা সেই শিল্পী ছিলেন কিশোরকুমার। তাঁর বহু জনপ্রিয় গানের সুরকার ছিলেন গায়ক শ্যামল মিত্র। এক বার হাওড়ার বাগনানেরএকটি অনুষ্ঠান-মঞ্চে গাইতে উঠে অসুস্থ হয়ে পড়েন শ্যামলবাবু। সেই ঘটনার উল্লেখ করে তাঁর ছেলে সঙ্গীতশিল্পী সৈকত মিত্র বলছেন, ‘‘উদ্যোক্তারাই বাবাকে ধরে এনে গাড়িতে শুইয়ে দিয়েছিলেন। বাবাকে গাইতে হয়নি। যুগের নিয়ম মেনে এখন শ্রোতা কিংবা উদ্যোক্তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে। কেকে-র মৃত্যুতে উদ্যোক্তাদের গাফিলতি অবশ্যই দায়ী।’’
কিশোরকুমার এবং কেকে-র সময়ের মধ্যে তফাত এখানেই। কেকে-র মৃত্যুর পরে যা সামনে এসেছে তা হল, অসুস্থ বোধ করার পরেও খানিক বিশ্রাম নিয়ে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন ফের অনুষ্ঠান করতে। ২০টি গান মঙ্গলবার তাঁর গাওয়ার কথা ছিল। সেই সঙ্গে গানের তালে নাচের ধকলও নিতে হয়েছিল অসুস্থ শরীরকে। বর্তমান যুগে অনেক ক্ষেত্রেই সঙ্গীতশিল্পীরা এ ভাবেই শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করেন।
জলসা হোক কিংবা সঙ্গীত সম্মেলন, অতীতে অনেক ঘটনাতেই অধিক মাত্রায় শারীরিক অসুস্থতার কথা শ্রোতা কিংবা আয়োজক-উদ্যোক্তাদের জানালে ছাড় মিলত শিল্পীদের। দিনের দিন অনুষ্ঠানে তেমন কিছু ঘটলে জলসা বাতিল করে পরবর্তী দিন বা বিকল্প শিল্পী খুঁজে নেওয়া হত। সঙ্গীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার ইউটিউব ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, অসুস্থ অবস্থায় মঞ্চে তিনি পাখার সামনে বসে রয়েছেন, তাঁর সামনে তাঁর জনপ্রিয় গানগুলি পরিবেশন করছেন অনামী শিল্পীরা। শ্রোতারা সন্তুষ্ট হয়ে সেই গানই শুনছেন।
ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলনের দুই বরিষ্ঠ সদস্য বাপ্পা সেন ওব্রতীন মুস্তাফি জানান, ১৯৮৬ সালে অসুস্থতা নিয়ে বিবেকানন্দ পার্কে বাজাতে বসে চল্লিশ মিনিটের বেশি বাজাতে পারেনি বিশিষ্ট সেতারশিল্পী নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন ওই মাপের শিল্পীরা আড়াই-তিন ঘণ্টা করে বাজাতেন। অসুস্থতার কথা শ্রোতাদের জানিয়ে বাড়ি ফিরে যান নিখিলবাবু। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তার দু’দিন পরেই মৃত্যু হয় তাঁর।
কিন্তু এখন কি শ্রোতা, উদ্যোক্তা কিংবা আয়োজকেরা সেই উদারতা দেখাতে চান না?
কিশোরকুমারকে মেদিনীপুরের সেই অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিলেন আয়োজক তোচন ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘বর্তমান যুগের শ্রোতা কিংবা উদ্যোক্তাদের সিংহভাগই উগ্র মানসিকতার। ’৭৬ সালের সেই অনুষ্ঠানের টাকা উঠেছিল কিশোরকুমারের নামেই। তা-ও তাঁর সমস্যা শুনে শ্রোতা কিংবা উদ্যোক্তারা তাঁকে গান গাওয়ার জন্য জোর করেননি। আজকের দিনে এটা সম্ভব হত না। বায়না নিয়ে নিলে শিল্পীকে যে কোনও মূল্যে মঞ্চে তোলার প্রবণতা এখন খুব বেশি।’’
প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্ল আবার বলছেন, ‘‘আমার তো মনে হয় শ্রোতাদের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে শিল্পীর উপরে চাপ তৈরি করেন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারাই। বিশেষত জলসায় যাঁরা শিল্পীদের নিয়ে যান, সেই সব আয়োজকদের একাংশ।’’ হৈমন্তীর মত, শ্রোতারা এতটাও নিষ্ঠুর নন যে কেকে অসুস্থ জানতে পারলেও তাঁকে দিয়ে জোর করে গাওয়াতেন। বরং টাকা নিয়ে নেওয়ায় আয়োজকদের একটা অংশ শিল্পীর উপরে চাপ সৃষ্টি করেন। সেই অভিজ্ঞতা তাঁর একাধিক বার হয়েছে বলে জানাচ্ছেন শিল্পী। তিনি বলেন, ‘‘এমনও শুনেছি, আমি মঞ্চে যেতে না পারলেও যেন আমার মৃতদেহ পৌঁছে যায়।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy