গাছ রয়েছে নিউটাউনে। কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে গিয়েছে বীরভূম-পুরুলিয়া-বর্ধমানে!
সিন্ডিকেটের কারবারিরা বলছেন, বালি-পাথরের মতো শহরের ইমারতি দ্রব্যের সরবরাহ আসে বীরভূম-পুরুলিয়া-বর্ধমানের মতো জেলাগুলি থেকে। তাই এখানকার সিন্ডিকেটের কারবারিদের সঙ্গে ওই জেলাগুলির বালি-পাথর খাদানের মালিকদের শক্তপোক্ত ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। শুধু তাই নয়, বালি-পাথর বিক্রির জন্য খাদানের বাইরে গজিয়ে উঠেছে একাধিক সিন্ডিকেট!
নিউটাউনের সিন্ডিকেট রাজ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় হয়ে উঠেছে পুলিশ। পাকড়াও করা হচ্ছে সিন্ডিকেট চক্রের মাথাদের। কিন্তু শুধু মাথা ছাঁটলেই কি সিন্ডিকেটের এই ‘বিষবৃক্ষ’ মুড়োবে? রাজারহাট-নিউটাউনের সিন্ডিকেট ব্যবসার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে কিন্তু তেমন কোনও ইঙ্গিত মিলছে না। বরং ওই ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিউটাউনে যত দিন নির্মাণ কাজ থাকবে, তত দিনই সিন্ডিকেট থাকবে। কেন?
সিন্ডিকেট সূত্রের খবর, নির্মাণ করার জন্য ইমারতি দ্রব্য লাগবেই। কিন্তু নির্মাণ ব্যবসায়ী বা প্রোমোটারেরা নিজেরা সেই মালপত্র কিনে ব্যবসা করবেন, এমনটা কার্যত অসম্ভব। কারণ, নিউটাউন এলাকার সিন্ডিকেট চক্র ছাড়া খাদান থেকে সরাসরি বালি-পাথর কিনতে পারবেন না নির্মাণ ব্যবসায়ীরা। নিউটাউনে শাসক দলের কর্মীদের একটি অংশই বলছেন, প্রোমোটারেরা নিজেরা বালি-পাথর কিনতে গেলেই ওই এলাকার সিন্ডিকেটের কাছে খবর পৌঁছে যাবে। খাদানের মালিকও যে সরাসরি বালি-পাথর বেচবেন, সেই পথও বন্ধ করা রয়েছে।
তা হলে কী ভাবে বালি-পাথরের ব্যবসা চলে? ইমারতি দ্রব্যের এক ব্যবসায়ী জানান, খাদানের বাইরেই একের পর এক গুমটি ঘরে রয়েছে সিন্ডিকেটের অফিস। কতটা মালপত্র লাগবে, সেই হিসেব করে ওই সিন্ডিকেটের অফিসেই টাকা দিতে হয়। তার পরে খাদানে গাড়ি লাগে। একের পর এক গাড়়িতে বালি-পাথর বোঝাই করা শুরু হয়। ওই ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘খাদান সিন্ডিকেটের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক গভীর থাকলে তবেই দেখার সুযোগ পাবেন ঠিক-ঠিক মাপে গাড়ি বোঝাই হচ্ছে কি না, নচেৎ নয়!’’
এই সম্পর্কের জোরেই সিন্ডিকেট ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী নিউটাউনের যুবকেরা। তাঁরা বলছেন, সিন্ডিকেট ব্যবসায় যদি কোপ পড়ে, তা হলে নিউটাউনের নির্মাণ শিল্পই মুখ থুবড়ে পড়বে। প্রোমোটারেরা সরাসরি গিয়ে এক মুঠো বালিও নিয়ে আসতে পারবেন না!
এই প্রসঙ্গে বছর দুয়েক আগের একটি ঘটনার কথা শুনিয়েছেন এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা। তিনি বলছেন, খাদান থেকে বালি-পাথর বোঝাই লরিগুলিকে হাইওয়েতে ‘ওভারলোডিং’-এর জন্য ধরছিল পুলিশ। তার ফলে জোগান ধাক্কা খাচ্ছিল। নিউটাউনের নির্মাণকাজ থমকে যাচ্ছিল। শেষে হস্তক্ষেপ করেন প্রশাসনের একেবারে শীর্ষ মহল। তার পর থেকে ওভারলোডিং নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের আর মাথাব্যথা নেই বলে ওই নেতার দাবি। তাঁর কথায়, ‘‘বালি-পাথর না এলে খোদ সরকারি সংস্থার কাজও যে আটকে যাবে!’’
কিন্তু ব্যবসায় এই ‘জুলুমবাজি’ সহ্য করা হবে কেন?
সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত লোকেদের দাবি, এটা ছাড়া কোনও উপায় নেই তাঁদের। কারণ, জমিহারা মানুষেরা অল্প পুঁজি দিয়ে সমবায়ের ধাঁচে এক-একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। মাসের শেষে পুঁজির অনুপাতে লভ্যাংশ বিলিবণ্টন করা হয়। এই সিন্ডিকেটের রোজগার থেকেই দিন চলে তাঁদের। তাই এই ব্যবসার উপর কোনও ‘আঘাত’ তাঁরা মেনে নেবেন না। ওই এলাকায় সিন্ডিকেটের হালহকিকত জানা তৃণমূলের এক নেতা বলছেন, সিন্ডিকেটের যে গোলমাল ঘিরে নিউটাউন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তার পিছনেও রয়েছে ব্যবসায় কোপ পড়া। তাঁর ব্যাখ্যা— আগে প্রতিটি সিন্ডিকেটের এলাকা ভাগ করা ছিল। ধীরে ধীরে অনেক সিন্ডিকেটের নিজস্ব এলাকায় নির্মাণকাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। ফলে নতুন করে টাকা রোজগারের পথ আর নেই। সেই সিন্ডিকেটগুলো এখন অন্য সিন্ডিকেটের এলাকায় কাজ করতে চাইছে। তা নিয়েই বাধছে গোলমাল। সংঘর্ষ-রক্তারক্তি। সেই সিন্ডেকেট পাণ্ডাদের কয়েক জনকে সম্প্রতি গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এঁদের কেউ বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের অনুগত, কেউ আবার প্রতিপক্ষ বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের। এ দিন অবশ্য কাকলিদেবী অভিযোগ করেছেন, গ্রেফতার হওয়া সিন্ডিকেট পাণ্ডাদের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে কুৎসা করা হচ্ছে। সিন্ডিকেট পাণ্ডা ধৃত হায়দার আলি মোল্লা কিংবা রুইস মন্ডল তাঁর লোক নয় বলে আজ দাবি করেছেন তিনি। কাকলিদেবী বলেন,‘‘আমার সঙ্গে সিন্ডিকেটের কোনও যোগাযোগ নেই। সিন্ডিকেটের লভ্যাংশ আমি নিই না। সিন্ডিকেট থেকে এক টাকাও আমি ঘরে তুলি না। অযথা আমার নাম এ সবের মধ্যে জড়ানো হচ্ছে।’’
যদিও তাঁর কথা শুনে হাসছেন নিউটাউনের তৃণমূল নেতাদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, সিন্ডিকেট ঘিরে বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে অন্য পেশার হদিস না দিলে এই সংঘর্ষ থামবে না। কিন্তু কাঁচা টাকার মৌঁতাতে থাকা যুবকেরা কি অন্য কোনও পেশায় যাবেন? বিশেষ করে যেখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকায় বেশি আয়ের সুযোগ তাঁদের নেই? এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত শাসক দলের নেতাদের কাছে মেলেনি।
প্রশ্ন উঠেছে, জমি অধিগ্রহণ করে অন্য রাজ্যেও তো নতুন শহর গড়ে উঠছে। সেখানেও কি সিন্ডিকেট রয়েছে?
এ প্রশ্নের উত্তরও স্পষ্ট ভাবে মেলেনি। তবে শহরের এক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, মার্বেল পাথর কিনতে নিয়মিত রাজস্থানে যেতে হয় তাঁকে। সেখানে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হলেও কোনও সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব নেই বলে তাঁর দাবি। তিনি বলেন, ‘‘আমরা সোজা খাদান মালিকের অফিসে যাই। চেকে টাকা লেনদেন হয়। পাথরও নিশ্চিন্তে চলে আসে কলকাতায়!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy