একসঙ্গে: পুজোর দিনে হাত ধরাধরি করে স্কুলের অলিন্দে দুই খুদে। সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে। ছবি: সুমন বল্লভ।
নবমের হলুদ শাড়ি একাদশের নীল পাঞ্জাবিকে বলেছিল, পুজোর দিন দুপুর দেড়টা নাগাদ তাদের স্কুলে যাবে। হলুদ শাড়ির অপেক্ষায় নীল পাঞ্জাবি স্কুলে চলে এসেছিল বেলা ১১টায়। তবে নীল পাঞ্জাবির প্রতীক্ষা শেষ হল পৌনে ২টো নাগাদ।
কোভিডের বিধিনিষেধ মেনে স্কুল খুলেছে গত বৃহস্পতিবার। দেখাও হয়েছে অনেক বন্ধুর সঙ্গে। কিন্তু সেটা স্কুলের পোশাকে। শনিবার সরস্বতী পুজোর দিন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হল রঙিন পোশাক আর রঙিন মেজাজে। এ দিন আর স্কুলের গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকল না পড়ুয়ারা। প্রজাপতির মতোই একে অপরের স্কুলে উড়ে উড়ে রঙিন করে তুলল শিক্ষাঙ্গন।
“কত দিন পরে দেখা! তুই টেন, আর আমি টুয়েলভে উঠে গেলাম! সামনাসামনি অন্য রকম হয়ে গেছিস রে।” “এত দিন পরে যখন দেখাই হল, তখন সহজে ছাড়ব না। গিটারটা ছাড়িসনি তো?”
“ওরে, মাস্কটা খোল কিছু ক্ষণের জন্য। পুজোর দিন এত নিষেধ মানলে হয়?” “গত দু’বছরে কি এক বারও দেখা করার কথা মনে হল না?” এ
রকমই টুকরো টুকরো কথা ভেসে বেড়াচ্ছিল চারপাশে। স্কুল চত্বরে এত দিন পরে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ায় কেউ যেন অনর্গল বকবক করেই চলেছিল, কেউ ছিল খানিকটা লাজুক। কেউ আবার হাসি মুখে বন্ধুদের আবদার মেটাতে একের পর এক নিজস্বী তুলে যাচ্ছিল।
কার্যত দু’দিনের নোটিসে নিজের নিজের স্কুলের পুজো ঢেলে সাজিয়েছে সব পড়ুয়া। সকালের দিকে বেশির ভাগ স্কুলেই দেখা গেল গুটিকয়েক পড়ুয়াকে। বেলা বাড়তেই অবশ্য বদলে গেল সেই ছবি। উত্তরের হিন্দু, হেয়ার, বাগবাজার মাল্টিপারপাস,
সরস্বতী বালিকা বিদ্যালয়, টাকি বয়েজ় বা দক্ষিণের যাদবপুর বিদ্যাপীঠ, মিত্র ইনস্টিটিউশন, যোধপুর পার্ক বয়েজ়, বেলতলা গার্লস হাইস্কুল— সর্বত্রই ভিড় বাড়তে থাকে। স্কুল প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে পুনর্মিলনের কেন্দ্র। যদিও করোনার জন্য কিছু বিধিনিষেধ রয়ে গিয়েছে। ভোগ হয়নি বেশির ভাগ স্কুলেই। প্রসাদে শুধু দেওয়া হয়েছে ফল। তাতে কী! এই অগোছালো ভাবটাই এ বার পুজোর রিংটোন হয়ে থাকল, এমনটাই মনে করছে হিন্দু স্কুলের পড়ুয়ারা। ওই স্কুলের এক শিক্ষক বললেন, “আমাদের পুজো হয় একতলায়। এ বার দোতলায় করতে হল। আশা করি, পরের বার সব স্বাভাবিক হবে। ফিরে পাব পুরনো জায়গা।”
ঢাকের আওয়াজে গমগম করছিল সরস্বতী বালিকা বিদ্যালয়ের হলঘর। অঞ্জলি শুরু হবে কিছু ক্ষণের মধ্যে। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা জয়তী মজুমদার মিত্রকে ঢিপ করে প্রণাম করল স্কুলেরই এক সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। মুখে মাস্ক। জয়তী নিজেই খুলে দিলেন সেই ছাত্রীর মাস্ক। চিনতে পেরে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। বললেন, “এত দিন পরে দেখা। ওরা তো নিজের মেয়েরই মতো। মেয়েকে দেখে কেউ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারে?”
ছোট পাত্রে খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হচ্ছিল সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে। এক প্রাক্তন ছাত্র অনিমেষ মজুমদার বলেন, “খিচুড়ি খুব প্রিয়। সরস্বতী পুজোয় স্কুলের খিচুড়ি ভোগ না খেলে পুজোটাই তো সম্পূর্ণ হয় না।” অনিমেষ জানান, শুধু খিচুড়ি খেতেই নয়, বন্ধুদের সঙ্গে বছরে এক বার দেখা করতে তাঁরা প্রতি বছর সরস্বতী পুজোর দিনটাই বেছে নেন। এ দিন তাঁর ব্যাচের আরও পাঁচ বন্ধু এসেছিলেন। ফের স্কুলবেলার বন্ধুত্ব, ঝগড়া, অভিমান ঝালিয়ে নেওয়ায় ডুবে গেলেন ছয় যুবক।
কে যেন বলেছিলেন, মনের কোনও বয়স নেই! এ যে কথার কথা নয়, প্রমাণ হল এ দিন ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে এসে। ’৫৮, ’৬৫, ’৬৭, ’৭২ সালের ব্যাচের পড়ুয়ারাও পৌঁছে গিয়েছিলেন সেখানে। ’৫৮ সালের পড়ুয়ারা আজ আশি ছুঁইছুঁই। তাঁদেরই এক জন বললেন, “প্রতি বার স্কুলের সরস্বতী পুজোয় আসি নিজের শৈশব ফিরে পেতে। ছোট ছেলেমেয়েদের পুজোয় আনন্দ করতে দেখে নিজেদের দিনগুলোয় চলে যাই।” চামড়া কুঁচকে গেলে কী হবে, স্কুলের পুজোর স্মৃতি এখনও টানটান ওঁদের। প্রতিমা দেখেই শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে তাই এক জন বলে উঠলেন, ‘‘প্রতিমার মুখ সেই একই রকম রে! আমাদের সময়ে যে ঘরে পুজো হত, সেই ঘরেই এখনও পুজো হয়!’’
তবে কি সত্যিই স্কুলে সময় থমকে যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy