ফাইল চিত্র।
দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা তরুণী আচমকা পেট, বুক আর পিঠের অসহ্য ব্যথায় কাবু হয়ে যাচ্ছিলেন। আরামবাগের স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসায় জানা যায়, প্যাংক্রিয়াটাইটিসের কারণে এই যন্ত্রণা। কলকাতার কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে আরও জানা যায়, প্যাংক্রিয়াটাইটিস তো বটেই, রোগিণীর রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রাও বিপজ্জনক। গলার আলট্রাসোনোগ্রাফি করেও কারণ খুঁজে না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতাল দ্বারস্থ হয় এসএসকেএমের। সেখানেই চিকিৎসার পরে সুস্থ রোগিণী ও গর্ভস্থ শিশু। কোভিড আবহেও সরকারি হাসপাতালে এমন বিরল চিকিৎসায় উচ্ছ্বসিত ডাক্তারেরা।
ঠিক কী হয়েছিল বছর ঊনত্রিশের প্রিয়া বিশ্বাসের? মানবদেহের থাইরয়েড গ্রন্থির দু’টি লোবের পিছনে থাকে চারটি প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি। আকারে সর্ষে দানার মতো। প্রিয়ার তেমনই একটি গ্রন্থিতে ছিল তিন সেন্টিমিটার আয়তনের টিউমারটি। যার কারণেই অতিরিক্ত প্যারাথাইরয়েড হরমোন নিষ্কাশন হচ্ছিল। সেই হরমোন হাড় থেকে ক্যালসিয়াম এনে রক্তে মিশিয়ে দিচ্ছিল। ফলে হাড় ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছিল। অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম জমা হয়ে দুই কিডনিতে পাথর হয়ে গিয়েছিল।
এসএসকেএমের এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে রোগিণী আসেন তাঁর গর্ভধারণের ২৪ সপ্তাহের পরে। ওই অবস্থায় এমআরআই করা সম্ভব ছিল না। তাই গলার ইউএসজি করা হয়। প্যারাথাইরয়েড টিউমার ধরা পড়ে প্রথম এখানেই। কিছু দিন ওষুধ দিয়েও সাড়া মেলেনি। তখন অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত হয়। সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ছাড়াও শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকার, স্ত্রীরোগ চিকিৎসক সুভাষ বিশ্বাস, অ্যানাস্থেটিস্ট চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে চিকিৎসক দলের পর্যবেক্ষণ চলতে থাকে। সম্পূর্ণ অ্যানাস্থেশিয়া রোগীর ঝুঁকি বাড়াবে বুঝে সারভাইক্যাল ব্লক করে ১৫ মিনিটে মিনিম্যালি ইনভেসিভ প্যারাথাইরয়েডএকটোমির (এম আই পি) মাধ্যমে টিউমার বার করা হয়।
সতীনাথবাবু জানাচ্ছেন, অস্ত্রোপচারের আধ ঘণ্টা পর দেখা যায়, রক্তে প্যারাথাইরয়েড হরমোন ৪০। চিকিৎসার শুরুতে যা ছিল ১৫০০! ওই সন্ধ্যায় ক্যালসিয়াম ১২ হয়। তাঁর কথায়, “অস্ত্রোপচারের আগে ক্যালসিয়াম ১৩.৫ ছিল। ওই পরিস্থিতিতে কোমায় চলে যেতে পারতেন রোগী। অস্ত্রোপচার জরুরি ছিল আরও দু’টি কারণে। প্যাংক্রিয়াটাইটিসের যন্ত্রণা ঘন ঘন হচ্ছিল। আর একের পর এক অঙ্গে প্রভাব পড়ছিল। যেমন, দু’টি কিডনিতেই পাথর হয়েছিল।”
দীপ্তেন্দ্র সরকারের কথায়, “কোভিড সংক্রমণের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও যে রোগের উৎস নির্ণয় করে চিকিৎসা হয়েছে, সেটাই ভরসা জোগাবে মানুষকে। কোভিড ছাড়া অন্য চিকিৎসাও হচ্ছে। তাই রোগ চেপে জটিলতা বাড়াবেন না।” তাঁরা এও জানাচ্ছেন, প্যারাথাইরয়েডের চিকিৎসা শহরের সর্বত্র হয় না। তবে এসএসকেএমে প্যারাথাইরয়েড ইউনিট আছে। সেখানে চিকিৎসা হচ্ছে।
স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “প্যারাথাইরয়েডে টিউমার সচরাচর শোনা যায় না। গর্ভাবস্থায় এই সমস্যা মা এবং শিশু, দু’জনের ক্ষেত্রেই ঝুঁকির। রোগের উৎস নির্ণয় না করা গেলে জরায়ুর বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারত। ভ্রূণের উপরে যার প্রভাব পড়ত। সময়ের আগেই প্রসব হতে পারত। এমনকি গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা চার থেকে পাঁচ গুণ বেড়ে যেত। সেখানে ঠিক চিকিৎসায় দুটো জীবন বেঁচেছে, যা এই সময়ের প্রেক্ষিতে অনেক বেশি প্রশংসনীয়।”
আর ওই ব্যথা ফিরে আসেনি প্রিয়ার। খাওয়াদাওয়া অনেকটা স্বাভাবিক। ফোনে তরুণী বলেন, “পাঁচ বছর অপেক্ষার পরে মা হতে চলেছি। হারাতে চাইনি সন্তানকে। ডাক্তাবাবুদের সে কথা বলেছিলাম। ওঁরা ওকে রক্ষা করার যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তা রেখেছেন। আমরা কৃতজ্ঞ বললে কম বলা হবে। এখন শুধু সুস্থ ভাবে ওকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চাই। আর কিছু চাই না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy