ফাইল চিত্র।
গঙ্গায় দেহ ভাসালে মোক্ষলাভ হবে— এই ধর্মীয় বিশ্বাসে সেখানে আধপোড়া দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় ২০০ টন আধপোড়া মৃতদেহ এ ভাবেই ভেসে চলে গঙ্গায়। বারাণসীর মণিকর্ণিকা ও হরিশ্চন্দ্র ঘাটে আবার প্রতি বছর গড়ে ৩২ হাজার মৃতদেহ দাহ করা হয়। সেই সৎকারের পরে প্রায় ৩০০ টন ছাই পড়ে গঙ্গায়। যা গঙ্গা দূষণের অন্যতম কারণ। বছর পাঁচেক আগে জাতীয় পরিবেশ আদালতে এই মর্মেই হলফনামা জমা দিয়েছিলেন এক আইনজীবী। যার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার ও উত্তরপ্রদেশ সরকারকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করেছিল পরিবেশ আদালত।
কিন্তু তার পরেও যে পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি, তা সাম্প্রতিক ঘটনাতেই স্পষ্ট। যেখানে কোভিডে আক্রান্ত মৃতদেহ দাহ না করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আর এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে সরব হয়েছেন উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের একাধিক রাজ্যের নদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা। তাঁদের বক্তব্য, অতিমারির কারণে গঙ্গায় মৃতদেহ ভাসার বিষয়টি নিয়ে শোরগোল হচ্ছে। কিন্তু এমনি সময়েও এমন ঘটনা ঘটে থাকে। যেখানে মরদেহের সম্মানজনক অন্ত্যেষ্টি-পর্ব ব্রাত্যই থেকে যায়!
উত্তরপ্রদেশের গঙ্গা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা এ ক্ষেত্রে ২০১৫ সালে উন্নাও জেলার একটি ঘটনার প্রসঙ্গ উল্লেখ করছেন। যেখানে ওই জেলা সংলগ্ন গঙ্গায় প্রায় ১০০টি মরদেহ ভাসতে দেখা গিয়েছিল। নদীর তীরে আটকে যাওয়া মরদেহ ঘিরে রেখেছিল কুকুর-শকুনের দল। সেই ঘটনারই যেন পুনরাবৃত্তি হচ্ছে করোনা-কালে। কানপুরের বাসিন্দা, নদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তথা তথ্যের অধিকার নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী (আরটিআই অ্যাক্টিভিস্ট) শঙ্কর বলছেন, ‘‘কোভিডে মৃতের প্রসঙ্গ উঠলেই তো প্রশাসন তথ্য চাপছে। এ দিকে, গঙ্গায় মরদেহ ভেসে যাচ্ছে।’’ ওই রাজ্যেরই আর এক নদী আন্দোলনকারীর বক্তব্য, ‘‘কোভিডে মৃতদেহের সৎকার যাতে সম্মানজনক ভাবে হয়, সে কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনও প্রতিফলন নেই।’’
বারাণসীর গঙ্গা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা জানাচ্ছেন, অনেক জায়গায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, কোভিড-দেহ সৎকারের জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও আবার জায়গা পাওয়া গেলেও মরদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার পর্যাপ্ত লোক নেই। ফলে রাতের অন্ধকারে ওই দেহ গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আবার অনেক জায়গায় গঙ্গার পাড়েই কিছুটা গর্ত করে মরদেহ পুঁতে দেওয়া হচ্ছে।
নদী আন্দোলন-কর্মী বল্লভচার্য পাণ্ডের কথায়, ‘‘গঙ্গায় জল বাড়লেই বালিতে পোঁতা মৃতদেহ বেরিয়ে আসছে। তার পরে গঙ্গার স্রোত তা টেনে নিয়ে যাচ্ছে।’’ গবেষণা জানাচ্ছে, শুধু বারাণসীর ঘাটেই প্রতি বছর প্রায় তিন হাজার মরদেহ গঙ্গায় ভাসতে দেখা যায়। দিনে গড়ে ৮-১০টি দেহ গঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে, এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে। করোনা সংক্রমণ সেই বিষয়টিকেই আলাদা মাত্রা দিয়েছে।
বিহারের গঙ্গা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের আবার বক্তব্য, গ্রামীণ এলাকায় অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা সংক্রমণের শুরুতে চিকিৎসা করাচ্ছেন না। ফলে যেটা হচ্ছে, একটা শ্রেণি নিজেরাই সুস্থ হয়ে উঠলেও যাঁরা পারছেন না, তাঁদের শেষ মুহূর্তে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এক নদী আন্দোলনকারীর বক্তব্য, ‘‘কিন্তু তাতে দেরি হওয়ায় তাঁদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠেরই মৃত্যু হচ্ছে।’’ ‘‘এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শ্মশানঘাটগুলিতে কাঠের অপ্রতুল জোগান। সৎকারের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। তাই মরদেহ গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে।’’— বলছেন পটনার বাসিন্দা, নদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মী আশিস রঞ্জন। ফলে মোক্ষলাভ না করোনার সময়ে দাহ করার পর্যাপ্ত কাঠের অভাবে মৃতদেহ গঙ্গায় ফেলা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই।
তবে কারণ যা-ই হোক, অনেকের বক্তব্য, গঙ্গায় মৃতদেহ ফেলা যাবে না, এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। এ-ও বলা হয়েছে, গঙ্গায় মরদেহ দেখা গেলে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় প্রশাসনকেই তার সৎকারের উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। যার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের নদী আন্দোলন-কর্মী গৌতম দে সরকার বলছেন, ‘‘গঙ্গাকে দূষণমুক্ত রাখার অনেক নির্দেশ, কেন্দ্রীয় প্রকল্প থাকলেও পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে করোনা-কালে তা ধুয়েমুছে গিয়েছে!’’
ফলে প্রায় ২৫৩২ কিলোমিটার যাত্রাপথে আরও কত কোভিডে মৃতের দেহ বহন করতে হবে গঙ্গাকে, সেই আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy