কয়েদের ছোট্ট কুঠুরি। ভাল করে আলো ঢোকে না। তবু তার মধ্যেই স্বস্তির শ্বাস পড়ল অস্কার ওয়াইল্ডের। কারণ, এত দিন জীবন বলতে তো শুধু ঘানি পেষা, ট্রেডহুইল সচল রাখতে অক্লান্ত ভাবে হাঁটা-সহ কঠোর শারীরিক শ্রম— এটুকুই ছিল। সেখানে লেখার আবেদন মঞ্জুর হওয়াটা কম কথা নাকি!
অস্কার আস্তে আস্তে এসে বসলেন কাগজের কাছে। লিখতে শুরু করলেন, ‘প্রিয় বোসি...’
১৮৯৫ সাল। নভেম্বর মাসের বৃষ্টি। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো অস্কার ওয়াইল্ডকে ঘিরে ধরেছে উন্মত্ত জনতা। কেউ ধিক্কার দিচ্ছেন, কেউ গালাগাল করছেন, কেউ গায়ে থুতু ছিটিয়ে দিচ্ছেন। আর সেই অপমানের মধ্যে দাঁড়ানো অস্কারের অশ্রুবিন্দু মিশে যাচ্ছে বৃষ্টিজলের সঙ্গে। কারারক্ষীরা যেন কিছুটা ইচ্ছাকৃত ভাবেই হেনস্থা হওয়ার জন্য অস্কারকে জনতার মধ্যে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারণ, অস্কার তো সমকামী!— যে ‘গ্রস ইনডিসেন্সি’র জন্য তাঁকে দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
ব্রিটিশ আমলে তৈরি, ১৮৬১ সালের ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় সমকামিতাকে অপরাধের তকমা দেওয়া হয়েছিল এ দেশেও। শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
কিন্তু তার পরেও কি কোনও পরিবর্তন হয়েছে?
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত ভাণ্ডারির বক্তব্য, ‘‘আইন আইনের কাজ করেছে। তবে, সমকামিতা সম্পর্কে ধারণা পাল্টাতে গেলে সমাজকেই তার দায়িত্ব নিতে হবে।’’ তবে অনেকের মতে, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সমাজের একটা বড় অংশের কাছে সমকামিতা এখনও বিদ্রুপ, উপহাসের বিষয়। যেমনটা অস্কারের সময়েও ছিল।
‘চার্লি পার্কারের (অস্কারের আর এক পুরুষসঙ্গী) উদ্দেশে আপনি কবিতা লিখেছিলেন?’
‘আমার মনে পড়ছে না।’
‘পার্কারের বয়স কত?’
‘আমি লোকের বয়স জিজ্ঞেস করে বেড়াই না। কারণ, কাউকে বয়স জিজ্ঞেস করাটা অশালীন মনে করি।’
আদালতে সমস্ত জিজ্ঞাসার এ ভাবেই সোজাসাপটা, বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিচ্ছেন সমকামিতায় অভিযুক্ত অস্কার। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন না যে, তাঁর নিজের
উত্তরই এমন একটি চক্রব্যূহ তৈরি করছে, যা থেকে বেরোনো মুশকিল। অথচ বন্ধুরা তা বুঝতে পেরেছিলেন। আর বুঝতে পেরেছিলেন বলেই আলফ্রেড ডগলাস ওরফে বোসির বাবা জন ডগলাস, নবম মার্কুইস অব কুইন্সবেরি তাঁকে ‘পায়ুকামী’ বলায় অস্কার যখন ডগলাসের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন, তখন বন্ধুরা বারণ করেছিলেন। কারণ, পুলিশি গ্রেফতারিতে শাপে বর হতে পারে ডগলাসের। এমনই আশঙ্কা ছিল বন্ধুদের। শেষ পর্যন্ত তাই-ই হয়েছিল। অস্কারের সঙ্গে নিজের ছেলে বোসিকে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেননি ডগলাস। তাই অস্কারের একাধিক পুরুষসঙ্গী সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য ডগলাস গোয়েন্দাদের কাজে লাগিয়েছিলেন। তার পরে কখনও ব্যক্তিগত লেখা চিঠি, কখনও লেখার অংশ তুলে ভরা আদালতে অস্কারের চরিত্র নিয়ে কাটাছেঁড়া চলেছিল।
‘‘দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে উপন্যাসে আপনি এক জন পুরুষের আর এক পুরুষের প্রতি মুগ্ধতার কথা বলেছিলেন। আপনি কখনও কোনও পুরুষকে দেখে মুগ্ধ হয়েছেন?’’— প্রশ্ন ধেয়ে এল। অস্কারকে সমকামী প্রমাণে বিরোধী পক্ষের এই
উপন্যাসকে হাতিয়ার করা অবশ্য প্রত্যাশিতই ছিল। কারণ, ১৮৯০ সালে লিপিনকট ম্যাগাজ়িনে প্রথম প্রকাশিত হওয়া মাত্র এই বইটি ‘অশ্লীল ও অনৈতিক বই’-এর তকমা পেয়েছিল। যার চাপে পড়ে পরবর্তীকালে অস্কারও কিছুটা পিছু হটেছিলেন। ২০১৮ সালে সংশ্লিষ্ট উপন্যাসের মূল পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশ্যে আসে। তাতে দেখা যায়, বই হিসেবে প্রকাশের জন্য অস্কার নিজের চার দিকে একটা নিয়ন্ত্রণরেখা টেনেছিলেন। কিন্তু অস্কারের আক্ষেপ ছিল, ‘‘এটা অনেকেই বোঝেন না, এক জন শিল্পীর তাঁর এক জন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বন্ধুর প্রতি গভীর স্নেহ, অনুরাগ থাকতেই পারে।’’ এখনও কি সমাজ বোঝে? বাচিক শিল্পী-অভিনেতা
সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘নাহ! বোঝে না। বরং এক জন নারীসুলভ পুরুষ বা পুরুষসুলভ নারীকে এখনও হাবেভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তুমি পৃথক। অথচ সংযুক্ত করা মানে শুধু লিঙ্গ-নিরপেক্ষতা (জেন্ডার-নিউট্রাল বা জেন্ডার-ফ্রেন্ডলি) নয়। বরং মানুষের মনোবৃত্তিকে প্রসারিত করা।’’ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর প্রশান্ত চক্রবর্তী আবার বলছেন,
‘‘অনেকে নিজেকে ‘প্রোগ্রেসিভ’ জাহিরের জন্য হয়তো সমকামিতা নিয়ে ফেসবুক-সহ সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা পোস্ট করেন। কিন্তু সমকামিতাকে মন থেকে গ্রহণ না করলে লিঙ্গবৈষম্য কাটবে না।’’
যে বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন অস্কার। একের পর এক ব্যক্তিগত মুহূর্ত আদালতে তুলে এনে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করা হয়েছিল তাঁকে। শেষ পর্যন্ত জন ডগলাসকে নির্দোষ ঘোষণা করেছিল আদালত। তত ক্ষণে অবশ্য সমলিঙ্গগামী সম্পর্কের যে আগ্নেয়স্তূপের উপরে বসেছিলেন অস্কার, তার বিস্ফোরণ হয়ে গিয়েছে। যার ফল, অস্কারের বিরুদ্ধে আবার মামলা শুরু হয়েছিল। বন্ধুরা অস্কারকে বলেছিলেন, দেশ ছেড়ে চলে যেতে। অস্কারের উত্তর ছিল, ‘অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ট্রেন চলে গিয়েছে।’
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy