জানবাজারে রানি রাসমণির বাড়িতে চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
নিষ্ঠা সহকারে, নির্ঘণ্ট মেনে দেবী আরাধনায় ফাঁক থাকে না তাঁদের। কোভিড-কালেও সেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে, আর জি কর-কাণ্ডের আবহে এ বছর পরিস্থিতি খানিক আলাদা। সে কথা মাথায় রেখেই উৎসবের জাঁকজমকে রাশ টানার পথে হাঁটছে শহরের বেশ কিছু বনেদি বাড়ি। কেউ নীরবতা পালন করে, কেউ শোভাযাত্রার জৌলুসকে বাদ দিয়ে প্রতিবাদী সুর জিইয়ে রাখতে চাইছেন। কেউ আবার বন্ধ করছেন বাড়ির সিংহদুয়ার।
প্রতিবাদ, না কি উৎসব? আর জি কর-কাণ্ডের আবহে মণ্ডপ বয়কটের পক্ষে মত দিয়েছিলেন অনেকে। মুখ্যমন্ত্রীর ‘উৎসবে ফিরুন’ পরামর্শের পরেও সরকারি অনুদান প্রত্যাখ্যানের পথে হেঁটেছেন কিছু পুজো উদ্যোক্তা। আর জি কর-কাণ্ডের ভয়াবহতা ও আন্দোলনের ঢেউ শহরের বনেদি বাড়িগুলির সদস্যদেরও স্পর্শ করেছে। তাই তাঁদের অনেকেই চাইছেন— ‘এ বার পুজো হোক, উৎসব নয়।’
পলাশির যুদ্ধে জয়ের পরে শোভাবাজারের রাজবাড়িতে জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব। তাঁর ছোট ছেলে রাজা রাজকৃষ্ণ দেবের পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে, সেই জাঁকজমকেই কাটছাঁট করতে চলেছেন তাঁরা। রাজা নবকৃষ্ণ দেবের অষ্টম উত্তরসূরি তীর্থঙ্কর দেব জানালেন, ইংরেজ আমলে পুজোয় ঢাকের সঙ্গে বাজত স্কটিশ ব্যান্ড। পঞ্চাশের দশক থেকে পুজোর শোভাযাত্রায় সঙ্গী ব্রিটিশ ঘরানার ব্যান্ড। রাজবাড়ি থেকে গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত রাস্তায় ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’ গানটি বাজানো রীতি তাঁদের। ‘‘এ বার পুজোয় আমরা বাদ দিচ্ছি সেই অবিচ্ছেদ্য ব্যান্ডকেই। কলাবৌ স্নান থেকে বিসর্জনের শোভাযাত্রা, সবেতেই ব্যান্ড এ বার ব্রাত্য’’— বলছেন তীর্থঙ্কর।
জানবাজারে রানি রাসমণির ২৩৪ বছরের পুরনো পুজোতেও থাকছে আর জি কর-কাণ্ডের ছোঁয়া। পরিবারের সদস্য প্রসূন হাজরা জানালেন, নির্যাতিতার স্মরণে পুজোর দিনে এক মিনিট করে নীরবতা পালন করা হবে। বাড়িতে ভোগের এলাহি আয়োজনেও রাশ টানার কথা ভাবা হয়েছে। আর জি কর-আবহে এই প্রথম জনসাধারণের জন্য বাড়ির দরজা বন্ধ রাখতে চলেছে
ভবানীপুরের মল্লিক পরিবার। সেই বাড়ির মেয়ে, অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিকের কথায়, ‘‘উৎসবের মানসিকতা এ বার নেই। কিন্তু ১০০ বছরের পুজো উপলক্ষে বাইরে থেকে পরিবারের অনেক
সদস্য বাড়ি ফিরছেন। তবু আড়ম্বরপূর্ণ পুজো করতে চাইছি না। তাই বয়োজ্যেষ্ঠরা স্থির করেছেন, পুজো সীমিত থাকবে শুধু পরিবারের মধ্যেই।’’
আড়ম্বরের দিক থেকে এক সময়ে দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুজোকে টক্কর দিত জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়ির পুজো। ওই পরিবারের তরফে প্রিয়ব্রত দাঁ বলেন, ‘‘আর জি করের ঘটনায় সকলেই মানসিক ভাবে ধ্বস্ত। তাই পুজোর আমন্ত্রণপত্র পাঠানো বন্ধ রাখছি। পুজোর দিনে জনসাধারণের প্রতিমা দর্শনে বাধা নেই। তবে দালানে এসে গল্পগুজব, ভিডিয়ো-রিল বানানো বন্ধ করতে চাইছি।’’
ঢিল ছোড়া দূরত্বে থাকা জোড়াসাঁকোর নরসিংহ দাঁ বাড়ি অবশ্য প্রতিবাদের সঙ্গে পুজোকে মেলাতে নারাজ। ওই পরিবারের তরফে কৌশিক দাঁ-র মত, ‘‘প্রতিবাদী মিছিলে শামিল হয়েছি আমরাও। তবে প্রতিবাদের সঙ্গে বাড়ির পুজোকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। পুজোর দিনে আমাদের
দরজা সকলের জন্য খোলা থাকছে। ১৮৫৯ সাল থেকে যেমন অনাড়ম্বর ভাবে মাতৃ আরাধনা চলে আসছে, তেমনই হবে।’’
আর কলকাতার বাইরে? বাঙালিয়ানা, বনেদিয়ানার ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করা, পেশায় চিকিৎসক পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়
কলকাতা ও বাংলার বনেদি বাড়ির সদস্যদের এক ছাতার তলায় এনেছেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে। তিনি বলছেন, ‘‘কাটোয়া, কালনা, আন্দুল, জনাই থেকে ধান্যকুড়িয়া, শ্রীরামপুর— সর্বত্র বাড়ির পুজোর এক সুর। আর জি কর-কাণ্ডের প্রভাব কলকাতার বাইরেও পড়েছে। সেই সঙ্গে পুজোর মুখে বন্যার বিপর্যয়ও রয়েছে। তাই রূপক প্রতিবাদ হয়তো সব বাড়ির পুজোতেই থাকবে। তবে তাঁরা সকলেই একমত— পুজো হলেও এ বার উৎসবের আড়ম্বর নয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy