ফাইল চিত্র
রাহুমশাই একটা নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন।
‘লকলকে গোঁপ’ দিয়ে খপ করে পূর্ণচন্দ্র বা সূর্যদেবকে পাকড়াও করে মাখন মাখিয়ে কামড় তিনি আকছারই দিয়ে থাকেন। এই কলিযুগে রস-স্রষ্টা পরশুরাম তা রেখায়-লেখায় চিত্রিত করেছেন। এ যাত্রা আরও বড় দায়দায়িত্ব রাহুসাহেবের ঘাড়ে। গোটা বিশ্বই তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেও অত্যুক্তি হয় না। শোনা যাচ্ছে, এই অতিমারিতে কুপোকাত বিশ্বে আজ, রবিবার সূর্যগ্রহণের সৌজন্যে বিরাট ম্যাজিক ঘটতে পারে। সূর্যগ্রহণের সময়টিই অপ্রতিরোধ্য নোভেল করোনাভাইরাসকে অবধারিত ঘায়েল করে থামবে।
চেন্নাইয়ের জনৈক পরমাণু বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার পর্যন্ত এটাই বলেছে। দেশে-বিদেশে হোয়াটসঅ্যাপ-বিশ্বাসীদের বিশ্বাসটিও বদ্ধমূল, করোনা এ বার প্যাঁচে পড়ছে। বলা ভাল, কোভিড-১৯ রাহুর গ্রাসেই পড়তে চলেছে।
এই করোনা অতিমারির নেপথ্যে দুর্যোগটি নাকি ২৬ ডিসেম্বর গত সূর্যগ্রহণেই ঘটেছিল বলে সংবাদ সংস্থার খবরে পরমাণু বিজ্ঞানী সুন্দর কৃষ্ণের নামে দাবি উঠেছে। গ্রহণের সময়ে নির্গত নিউট্রনের সঙ্গে পরিবর্তমান কোনও কণার ধাক্কাতেই ‘কেলোর কীর্তি’! তাতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব বেসামাল। ফের সূর্যগ্রহণেই আগের বারের দোষ কাটবে বলে বিজ্ঞানীর অভিমত প্রকাশিত হয়েছে। চিনে করোনার উৎপত্তির তত্ত্ব পর্যন্ত খারিজ করে তিনি বলছেন, “ভাইরাসের আবির্ভাব ও বিনাশ দুটোই প্রাকৃতিক ব্যাপার। আসন্ন সূর্যগ্রহণের পরেই তা কমজোরি হবে। মানুষের ফাঁড়াও কাটবে।”
সার্বিক ভাবে বিজ্ঞানী মহলে এই মত নিয়ে তাপ-উত্তাপ নেই। তবে হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুকজীবীদের একাংশ উজ্জীবিত।
সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে উত্তেজনা নানা কারণেই ফিরে ফিরে আসে। ১৯৮০ সালে সূর্যগ্রহণের দিনই পৃথিবী ধ্বংস হবে ভেবে ভয়ে গৃহবন্দি কলকাতায় অলিখিত লকডাউন শুরু হয়ে যায়। ১৯৯৪-এ আবার সূর্যের পূর্ণগ্রাসে আকাশে অপরূপ হিরের আংটি দেখতে কলকাতার কাছেই ডায়মন্ড হারবারে ভিড় উপচে পড়েছিল।
মৃত্যুর ক’দিন আগে গ্রহণের প্রাক্কালে বেলুড়ের গঙ্গায় ওঠা টাটকা ইলিশ বাঙাল ভক্ত শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে রান্না করতে বললেন স্বামী বিবেকানন্দ। ইলিশের টক পর্যন্ত নানা পদ আয়েশ করে খেলেন। তার পরে সহাস্যে বললেন, ‘গেরহোন লেগেছে আমি যাই...ঘুমুই!’ শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত সাক্ষী, চন্দ্রগ্রহণের পরেই চৈতন্যদেবের জন্ম হচ্ছে। ‘অকলঙ্ক গৌরচন্দ্র দিলা দরশন, সকলঙ্ক চন্দ্রের আর কিবা প্রয়োজন’!
পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর মতে, “গ্রহণকে বুঝতে না-পেরেই মানুষ রাহু-কেতুর গল্প ফেঁদেছিল।
পুরাণগুলিও মঙ্গলকাব্যের মতো ভয় থেকে নানা দেবতা-অপদেবতাকে প্রতিষ্ঠা করে।” সমুদ্র মন্থনের সময়ে সূর্য-চন্দ্রের চক্রান্তেই অসুর রাহু-কেতুর অমৃতপান ভেস্তে যায়। বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র তাদের মুণ্ডচ্ছেদ করে। ধড়হীন সেই মুণ্ডের অনন্ত সূর্যচন্দ্র তৃষ্ণাকেই সূর্য, চন্দ্রের গ্রহণ বলে পুরাণের ব্যাখ্যা। তবে গ্রহণের অমঙ্গলের তত্ত্ব বা গ্রহণে ভাইরাস-বধের সম্ভাবনায় নৃসিংহবাবুর বিশ্বাস নেই। প্রবীণ পুরোহিত শম্ভুনাথ স্মৃতিতীর্থও বলছেন, “এত ভাবনা কী! গ্রহণের সময়ে সঙ্কল্পমন্ত্র পড়ে স্নান বা পিতৃগণের তর্পণ, শ্রাদ্ধের বিধান আছে।”
“পুরীতে জগন্নাথদেবের ভোগের আয়োজন কিন্তু গ্রহণের জন্য থামে না”, বলছিলেন মন্দিরের বড়গ্রাহী সেবায়েত রামচন্দ্র দয়িতাপতি। “আমরা ভগবানে বিশ্বাসী! সূর্যগ্রহণের ভালমন্দে মাথা ঘামাই না।”
তবু সূর্যগ্রহণের প্রতাপে কোভিড-বধ নিয়ে আমজনতার বিশ্বাস বলছে, কী হয়, কী হয়! পরশুরামের গল্পে পেট ফাঁপার ভয়ে রাহু কন্দর্পকে খেতে গররাজি হয়েছিলেন। এ যাত্রা, ভাইরাসকে গিলতে তিনি যেন না-ডোবান, এটাই অসহায়ের আশা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy