Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
গাড়িতে পিষে যান কেউ, ভারা থেকে পড়ে মৃত্যু হয় কারও। অংগঠিত শ্রমিকদের সুরক্ষা যেন সোনার পাথরবাটি। জোটে না ক্ষতিপূরণও।
Workers

‘ক্ষতিপূরণ কে দেবে? ১৮০ টাকা রোজের কাজে বিমা কই’

সাম্প্রতিক এক সকালে রবীন্দ্র সদনের দিক থেকে এ জে সি বসু উড়ালপুলে ওঠা একটি গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু হয় এই বস্তিরই বাসিন্দা পূর্ণিমা দেবীর (৫৭)।

অসহায়: সাফাইয়ের কাজ করতে গিয়ে পায়ে আঘাত লাগার কথা বলছেন মৃতা পূর্ণিমা দেবীর বোন সুমিত্রা। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

অসহায়: সাফাইয়ের কাজ করতে গিয়ে পায়ে আঘাত লাগার কথা বলছেন মৃতা পূর্ণিমা দেবীর বোন সুমিত্রা। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২২ ১০:২১
Share: Save:

ঘরের উচ্চতা এমনই যে, সেখানে সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না ঘরে ঢুকতে হয় কার্যত হামাগুড়ি দিয়ে। ছাউনি বলতে প্লাস্টিক। কুড়িয়ে আনা জিনিসপত্রের স্তূপের পাশেই কোনও মতে মাটিতে শোয়ার ব্যবস্থা। খোলা নর্দমা আর আবর্জনায় ঘেরা সেই সব ঘরের কাছে কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাই শক্ত দুর্গন্ধ ও মশার দাপটে। হাওড়ার জগৎ ব্যানার্জি ঘাট রোডের একটি বস্তির সেই সব ঘরে বাস করা মহিলাদের কারও পায়ে লোহার রড ঢোকানো, কেউ ভাঙা হাত-পা নিয়েই কোনও মতে আছেন। খুঁড়িয়ে, নয়তো ধীরে হাঁটতে হয় অনেককেই। কারও কারও আবার শরীরে একাধিক কাটা-ছেঁড়ার দাগ!

লক্ষ্মী দেবী নামে এমনই এক মহিলা কাটার দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘‘এই বস্তিতে এমন কাউকে পাবেন না, যিনি রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার কাজ করতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কা খাননি। এত দিন কেউ খোঁজ নিতে আসেননি। এখন আমাদের এক জন মারা গিয়েছেন বলে খোঁজ পড়েছে! ক্ষতিপূরণ কে দেবেন? ১৮০ টাকা রোজের ঝাঁট দেওয়ার কাজে আবার জীবন বিমা কই?’’

সাম্প্রতিক এক সকালে রবীন্দ্র সদনের দিক থেকে এ জে সি বসু উড়ালপুলে ওঠা একটি গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু হয় এই বস্তিরই বাসিন্দা পূর্ণিমা দেবীর (৫৭)। হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনার্সের (এইচআরবিসি) অধীনে থাকা ওই উড়ালপুলে সেই সময়ে রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার কাজ করছিলেন কয়েক জন। পুলিশ জানায়, তাঁরাও এইচআরবিসি-র অধীনেই কর্মরত। পূর্ণিমা ছিলেন তাঁদেরই এক জন। ঝাঁট দিয়ে সংগ্রহ করা ময়লা তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য উড়ালপুলের উপরে একটি ছোট লরি রাখা ছিল। সেটির সামনেই কাজ করছিলেন পূর্ণিমারা। দ্রুত গতিতে উড়ালপুলে ওঠা ওই গাড়িটি প্রথমে লরিতে ধাক্কা মারে। এর পরে পূর্ণিমাকে হেঁচড়ে বেশ কিছুটা নিয়ে যায়। গুরুতর জখম পূর্ণিমাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনায় প্রশ্ন ওঠে, যে উড়ালপুলে দ্রুত গতিতে গাড়ি চলে, সেখানে সকাল ৯টা পর্যন্ত রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার কাজ চলে কী করে? শ্রমিকদের সুরক্ষা বলতে পরনে উজ্জ্বল পোশাক ছাড়া আর কিছুই ছিল না কেন? কাজ চলাকালীন রাস্তার ওই অংশটি ঘেরা ছিল না কেন, সেই প্রশ্নও উঠেছে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, পূর্ণিমার বোন সুমিত্রা মণ্ডল বলেন, ‘‘ভয়ে আমরা কেউ কাজে যাচ্ছি না। ভোর চারটেয় উঠে রাস্তা ঝাঁট দিতে যেতাম। বহু বার গাড়ির ধাক্কায় আমাদের অনেকে আহত হয়েছেন। আমার পায়েও প্লাস্টার করাতে হয়েছে মোটরবাইকের ধাক্কা খাওয়ার পরে। কিন্তু বার বার বলা সত্ত্বেও সুরক্ষার ব্যবস্থা হয়নি। তবে তার খেসারত যে পূর্ণিমাকে দিতে হবে, তা ভাবিনি। ক্ষতিপূরণ কে দেবেন?’’ তিনি অবশ্য জানান, পূর্ণিমার শ্রাদ্ধকাজের জন্য ঠিকাদার সংস্থা ২০ হাজার টাকা দিয়েছে।

শ্রমিক-স্বার্থে কাজ করা সংগঠন, ‘নাগরিক মঞ্চ’-এর সাধারণ সম্পাদক নব দত্ত বলেন, ‘‘এই ধরনের শ্রমিকদের জন্য কল্যাণমূলক ফান্ড রয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু, এমনকি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেও সেই ফান্ড থেকেই তাঁদের সুবিধা পাওয়ার কথা। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, সেই ফান্ড অন্য ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, কিন্তু এঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিছু পান না।’’

এইচআরবিসি-র কর্তারা জানিয়েছেন, বিষয়টি আপাতত বিচারাধীন। আদালতের রায় মেনেই ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু এমন শ্রমিকদের কোনও বিমা রয়েছে কি না, তার উত্তর দিতে পারেননি তাঁরা। বিষয়টি ঠিকাদার সংস্থা জানে বলে তাঁদের দাবি। জানা গিয়েছে, ‘তুহিন-তমাল কনস্ট্রাকশন’ (টিটিএস কনস্ট্রাকশন) নামে একটি সংস্থার অধীনে কাজ করতেন পূর্ণিমারা। এইচআরবিসি-র ডাকা দরপত্রের ভিত্তিতে হাওড়ার বেশ কিছু জায়গায় রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার কাজ পেয়েছে এই সংস্থা। কয়েক মাস আগে এ জে সি বসু উড়ালপুলের একাংশেও তারা ঝাঁট দেওয়ার কাজ শুরু করে। ওই সংস্থার মালিক তুহিন সরকারের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘ওই মহিলার পরিবার ক্ষতিপূরণ পাবে কি না, সেটা বাইরের কাউকে বলতে যাব কেন? এটুকু বলতে পারি, প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে। শ্রমিকদের অংশের টাকা সংস্থা থেকেই দিয়ে দেওয়া হয়।’’ কিন্তু অদক্ষ (আনস্কিলড) শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন যেখানে প্রতিদিন ৩৫৫ টাকা হওয়ার কথা, সেখানে পূর্ণিমাদের ১৮০ টাকা রোজ দেওয়া হয় কেন? তুহিনের উত্তর, ‘‘পরে কথা হবে।’’ যদিও পরে আর কোনও কথা বলেননি তিনি।

শ্রম দফতরের কর্তারা যদিও জানাচ্ছেন, এমনটা হওয়ার কথাই নয়। ঠিকাদার সংস্থা তো দেবেই, অসংগঠিত, পরিবহণ এবং নির্মাণ ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত হিসাবে শ্রম দফতরে নাম নথিভুক্ত করানো থাকলেই যে কোনও শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। দফতরের এক অতিরিক্ত কমিশনার বললেন, ‘‘ঠিকাদার সংস্থারই দায়িত্ব নিয়ে নাম নথিভুক্ত করানোর ব্যবস্থা করার কথা। কিন্তু বহু সংস্থাই তা করে না। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়ে থাকতে পারে।’’ তা হলে এমন সংস্থা দরপত্রে অংশ নেয় কী করে? উত্তর দিতে পারেননি কেউই।

অন্য বিষয়গুলি:

Workers Insurance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy