নিউ টাউনে রাস্তার উপরেই পড়ে নির্মাণ সামগ্রী। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পরে ছোট একটি বাড়ি করতে চেয়েছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহকর্তা। যুগের অলিখিত ‘নিয়ম’ মেনে স্থানীয় সিন্ডিকেটকেই ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের বরাত দিয়ে স্বস্তিতে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সাধলেন বেপাড়ার ‘দাদারা’। ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের বরাত দাবি করেন তাঁরাও। অভিযোগ, গৃহকর্তাকে রীতিমতো হুমকি দিয়ে বলা হয়, বরাত না পেলে নতুন বাড়ি তৈরি হলেই তা ভেঙে দেওয়া হবে। ঘটনাস্থল, রাজারহাট-নিউ টাউন এলাকা।
এক সময়ে এই এলাকাতেই শুরু হয়েছিল সেই ‘সিন্ডিকেট’ ব্যবস্থা, যা বর্তমানে কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যেই ডালপালা বিস্তার করেছে। বেকার যুবকদের নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহের ছাড়পত্র দেওয়ার আড়ালে আসলে রাজনৈতিক দাদা, নেতা, জনপ্রতিনিধিরা এলাকায় নিজেদের দখলদারি ও দাপট কায়েম রাখছেন। চলছে বেআইনি পথে হরেক উপায়ে টাকা রোজগারের এক বিকল্প অর্থনীতিও।
নিউ টাউনের এক ছাপোষা মধ্যবিত্তের ওই ঘটনাটি হিমশৈলের চূড়ামাত্র। একই জায়গায় একাধিক সিন্ডিকেট থাকায় সেখানে প্রোমোটার থেকে সাধারণ চাকুরে— নির্মাণকাজ শুরু করার আগে দশ বার ভাবতে হচ্ছে সবাইকেই। খবর মিলেছে, কোথাও কোথাও নির্দিষ্ট কোনও সিন্ডিকেটকে সরবরাহের বরাত দিয়েও নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। সেখানে আবার বেপাড়ার দাদারাও ঢুকে পড়ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রোমোটারদের একাংশ জানাচ্ছেন, এ সব ক্ষেত্রে তাঁরা এক দলকে সরবরাহের বরাত দিচ্ছেন। আর অন্য দলকে বাধ্য হয়ে নগদে ‘ক্ষতিপূরণ’ দিয়ে ঝামেলা এড়াচ্ছেন।
সূত্রের খবর, দিনকয়েক আগেই রাজারহাট এলাকার দুই দাপুটে জনপ্রতিনিধির অনুগামীরা একটি শপিং মলের সামনে নির্মাণ সামগ্রী ফেলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বচসায় জড়িয়ে পড়েন। দুই দলই সেখানে জড়ো হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত উপরতলার দু’দিকের দুই নেতার ফোন পেয়ে তাঁরা শান্ত হন।
একটি সূত্র জানাচ্ছে, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কাছে নিউ টাউন এখন গ্রাম ও শহর, এই দু’ভাগে বিভক্ত। শহর নিউ টাউনের তুলনায় নিউ টাউন বিধানসভা কেন্দ্রের অধীন রাজারহাট-বিষ্ণুপুর (১ এবং ২), পাথরঘাটা, চাঁদপুর— এই চারটি পঞ্চায়েত এলাকায় নির্মাণের কাজ বেশি হচ্ছে। সেখানে অনেক জায়গাতেই সিন্ডিকেটের নিজস্ব এলাকা বলে আর কিছু নেই। যে যেখানে গিয়ে পারছে, নির্মাণ সামগ্রী ফেলার চেষ্টা করছে। উপরের নেতারা রাশ টানতে না-পারলেই বেধে যাচ্ছে ঠোকাঠুকি।
বছর দুই আগে মহিষবাথান এলাকার বাসিন্দা এক যুবক একটি ভেড়িতে কাজ করতেন। তিনি জানালেন, নির্মাণ সামগ্রীর পাশাপাশি ভেড়ির কাজ নিয়েও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এলাকার দখল রাখেন জনপ্রতিনিধিরা। তাঁর কথায়, ‘‘ওই ভেড়িতে মাছ ছেড়েছিলেন এক জন। লকডাউনের সময়ে একটি গোষ্ঠী ভেড়ির দখল নেয়। যিনি মাছ ছেড়েছিলেন, মারধর করে তাঁর শিরদাঁড়া জখম করে দেওয়া হয়। একটি ছেলের পা ভেঙে দেওয়া হয়। সে এখনও চলতে পারে না।’’ যিনি ওই ঘটনায় মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন বলে অভিযোগ, তিনিই বর্তমানে জনপ্রতিনিধি। এখন এলাকার দখলও তিনিই নিয়েছেন। ঘটনার সময়ে যাঁরা তাঁকে সাহায্য করেছিলেন, এখন তাঁরা এবং ওই নেতার অনুগামীরা দুই যুযুধান পক্ষ।
নিউ টাউনের প্রাক্তন বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত, যিনি বর্তমানে বিধাননগর পুরসভার চেয়ারম্যান, এক সময়ে প্রকাশ্যেই সিন্ডিকেট ব্যবসার সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন। অভিযোগ, সেই সময়ে ভজাই, মাটি গফ্ফর, মিনি গফ্ফর, সইফুল, আলমদের মতো একাধিক শাসকদল-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির নাম উঠে আসে, যাঁদের সিন্ডিকেট-চাঁই বলেই জানতেন এলাকার লোকজন। সব্যসাচী দল বদল করে বিজেপিতে চলে যাওয়ার পরে ধীরে ধীরে নিউ টাউনের রাশ হাতে নিতে থাকেন বিধাননগরের তৎকালীন ডেপুটি মেয়র তাপস চট্টোপাধ্যায়। এখন তিনি নিউ টাউনের বিধায়ক।
এলাকার খবর, সব্যসাচীর অনুগামীদের একটি অংশ বসে গিয়েছেন। বাকিরা শিবির বদলে সক্রিয় রয়েছেন। সব্যসাচী অবশ্য সিন্ডিকেট নিয়ে কিছু বলতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘এখন নিউ টাউনের বিধায়ক যিনি, তাঁর সঙ্গে কথা বলুন।’’ অন্য দিকে, তাপস চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘সিন্ডিকেটের নামে জোরজুলুম যে বরদাস্ত করা হবে না, সেই নির্দেশ দেওয়া আছে সবাইকে। কোথাও বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটার খবর পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পুলিশও সক্রিয়।’’
স্থানীয়দের দাবি, আগের মতো আর প্রকাশ্যে অফিস খুলে বসেন না সিন্ডিকেটের লোকজন। এখন একই জায়গায় দু’-তিনটি করে ক্লাব দেখা যায়। এলাকার দখল রাখে তারাই। সিন্ডিকেট ব্যবসার দখল রাখতে এক গোষ্ঠীর সামগ্রী-বোঝাই লরি এলাকায় ঢোকার আগেই চালককে হুমকি দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাই আপাত শান্ত থাকে এলাকা। যা প্রকৃত পরিস্থিতির কোনও আভাস দেয় না। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy