Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

রক্তদানে বক্স বাজিয়ে ভোট-প্রচার বিশ্ববিদ্যালয়ে, ক্ষুব্ধ পার্থ

ভিতরে ক্লাস চলছে। আর বাইরে ক্যাম্পাস জুড়ে উড়ছে তৃণমূলের পতাকা। তারস্বরে বাজছে গাছে গাছে বাঁধা সাউন্ড বক্স। কখনও গান, কখনও বক্তৃতায় জমজমাট অনুষ্ঠান চলছে আশুতোষ হলে। উপলক্ষ রক্তদান। ফাঁকে ফাঁকে চলছে পুরভোটের প্রচারও। শাসক দলের শিক্ষাকর্মী সংগঠন ‘সারা বাংলা তৃণমূল শিক্ষাবন্ধু সমিতি’র সৌজন্যে মঙ্গলবার দিনভর এই ছবিই ধরা পড়ল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয় চলাকালীন এমন ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এ ব্যাপারে খোঁজখবর করে অনুষ্ঠানে জড়িতদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তৃণমূলের পতাকা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তৃণমূলের পতাকা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৪
Share: Save:

ভিতরে ক্লাস চলছে। আর বাইরে ক্যাম্পাস জুড়ে উড়ছে তৃণমূলের পতাকা। তারস্বরে বাজছে গাছে গাছে বাঁধা সাউন্ড বক্স। কখনও গান, কখনও বক্তৃতায় জমজমাট অনুষ্ঠান চলছে আশুতোষ হলে। উপলক্ষ রক্তদান। ফাঁকে ফাঁকে চলছে পুরভোটের প্রচারও। শাসক দলের শিক্ষাকর্মী সংগঠন ‘সারা বাংলা তৃণমূল শিক্ষাবন্ধু সমিতি’র সৌজন্যে মঙ্গলবার দিনভর এই ছবিই ধরা পড়ল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে।

বিশ্ববিদ্যালয় চলাকালীন এমন ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এ ব্যাপারে খোঁজখবর করে অনুষ্ঠানে জড়িতদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে। শিক্ষাবন্ধু সমিতির দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই যা করার করা হয়েছে।

কর্তৃপক্ষ কী করেছেন?

কর্তৃপক্ষ অনুষ্ঠান চলাকালীন আদৌ কোনও রকম বাধা দেননি। আপত্তিও জানাননি। উল্টে অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে উদ্যোক্তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কিছু কর্তা। ধ্রুবজ্যোতিবাবু পরে দাবি করেন, অনুষ্ঠানে শাসক দলের হয়ে প্রচার চলেছে বা বক্স বাজিয়ে গোটা ক্যাম্পাসে তার আওয়াজ শোনানো হয়েছে বলে তিনি জানতেন না।

আর উপাচার্য সুরঞ্জন দাস জানান, তিনি কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে পৌঁছন দেরিতে। তাই ঠিক কী হয়েছে, তাঁর জানা নেই। উপাচার্যের কথায়, ‘‘আমরা রক্তদান শিবির করার অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু বক্স বাজিয়ে গানবাজনা ইত্যাদি হয়েছে বলে শুনিনি। বিষয়টি খতিয়ে দেখার পরে সব জানাতে পারব।’’

চতুর্থ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে এ দিন রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেছিল শিক্ষাবন্ধু সমিতি। সেই উপলক্ষে গোটা ক্যাম্পাস তৃণমূলের পতাকায় ছেয়ে দেওয়া হয়। মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই চোখে পড়ে, গাছগুলিতে সারি সারি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে সাউন্ডবক্স। অনুষ্ঠানে হাজির স্থানীয় তৃণমূল নেতা চিনু হাজরা, রেহানা খাতুন, পার্থ বসুর মতো কাউন্সিলরেরাও। শিক্ষাকর্মীদের নানান দাবি জানানোর সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা তথা রাজ্য ও গোটা সমাজের উন্নয়নের স্বার্থে তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন অনুষ্ঠানের বিভিন্ন বক্তা।

এটাই প্রথম নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে বিতর্কে জড়িয়েছে শিক্ষাবন্ধু সমিতি। কখনও সমিতির প্রাক্তন নেতার বিরুদ্ধে তৃণমূলের বর্ষীয়ান নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে। কখনও আবার যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ। কখনও বা কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিকদের মারধরে অভিযুক্ত হয়েছেন শিক্ষাবন্ধু সমিতির কিছু কিছু সদস্য।

এই অবস্থায় ফের একটি বিতর্কিত অনু্ষ্ঠান আয়োজনের কারণ কী?

সমিতির সভাপতি দেবব্রত (গগন) সরকার বলেন, ‘‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই যা করার করেছি। আর মাইক বাজিয়ে অনুষ্ঠান হয়েছে তো হলের ভিতরে। বাইরে আওয়াজ পৌঁছয়নি।’’

তা হলে বাইরে অতগুলি সাউন্ড বক্স ছিল কেন? যথেষ্ট আওয়াজও তো হচ্ছিল। এ ব্যাপারে কী বলবেন?

দেবব্রতবাবুর দাবি, ‘‘বক্সগুলির তার কেটে দেওয়া হয়েছিল।’’ এ দিনের সভাও সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত ছিল বলে দাবি করেছেন তিনি।

সমিতির সহ-সভাপতি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কিত কর্মচারী নেতা বিনয় সিংহ অবশ্য রাখঢাক করেননি। সোজাসুজি বলে দেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজের বাইরে নয়! বড় বড় নেতা উঠে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তা ছাড়া আমরা তো অন্য গ্রহের মানুষ বা সাধুসন্ন্যাসী নই। নাগরিক দায়বদ্ধতা থেকেই এ দিন ভোটের আবেদন জানানো হয়েছে।’’

দেবব্রতবাবু বা বিনয়বাবুরা যে-দলের সঙ্গে যুক্ত, সেই তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবু অবশ্য শিক্ষাঙ্গনে এ ভাবে অনুষ্ঠান করার বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘‘জানতে পেরেছি, আমাদের দলের পতাকা নিয়ে কয়েক জন রক্তদান শিবিরের করেছেন। বাইরেও মাইক বেজেছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় চলাকালীন এ ধরনের অনুষ্ঠানের অনুমোদন দিই না। এ ব্যাপারে খোঁজখবর করে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি উপাচার্যকে।’’ কাজে ফাঁকি দিয়ে কারা এমন কাজ করেছেন, তা-ও খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। মন্ত্রীর এই বক্তব্য জানার পরে অবশ্য কিছুটা বিনয়ী হয়েছেন বিনয়বাবু। তাঁর কথায়, ‘‘অনেকেই ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। তবে মন্ত্রীর বক্তব্যকে সম্মান জানিয়ে তিনি যে-নির্দেশ দেবেন, তা মাথা পেতে নেব।’’

শিক্ষাবন্ধু সমিতির এ দিনের অনুষ্ঠানের বিরোধিতায় অনেক অভিজ্ঞ শিক্ষকই সরব হয়েছেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভোট-প্রচারের জায়গা নয়। সেখানে পড়াশোনার পরিবেশ খারাপ করার অধিকার কারও নেই। যা ঘটেছে, অত্যন্ত নিন্দনীয়। নাম শিক্ষাবন্ধু, তবে তাদের কাজটা শিক্ষাবান্ধবের মতো নয়।’’ এতে যে পঠনপাঠনের সুস্থ পরিবেশ নষ্ট হয়েছে, সেই ইঙ্গিত দিয়ে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অমিতা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা সব সময় চেয়েছি এবং চাইব, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন পঠনপাঠনের সুস্থ পরিবেশ বজায় থাকে।’’

যে-দল শিক্ষায় রাজনীতিকরণের অন্যতম পুরোধা বলে বরাবর সমালোচিত হয়ে এসেছে, সেই সিপিএমের এক কালের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরীও এ দিনের অনুষ্ঠানের নিন্দা করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘এমনটা আগে কখনও হয়েছে বলে মনে পড়ে না।’’ অর্থাৎ তাঁদের জমানায় এমন কিছু ঘটেনি বলে বামফ্রন্টের ওই মন্ত্রীর দাবি।

বর্তমান থেকে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ঘটনার সমালোচনায় মুখ খুললেও শাসক দলের শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুপা-র সভানেত্রী কৃষ্ণকলি বসু এ দিনের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘এই বিষয়টি আমার এক্তিয়ারে পড়ে না। এটা প্রশাসনিক ব্যাপার। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিকেরা অনুমতি দিয়ে থাকেন, এর উত্তর তাঁরা দেবেন।’’ কৃষ্ণকলিদেবীর বিরুদ্ধেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট রুমে ঢুকে উপাচার্যের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE