সাংবাদিকদের মুখোমুখি অরুণাভবাবু।
তদন্তকারীদের সামনে বসে তখন নথি জমা দিচ্ছেন তিনি। অথচ ততক্ষণে তাঁর বাড়িতেই হাজির হয়েছে তদন্তকারীদের আর একটি দল। তাই নিজের বাড়ির সামনে ফিরে প্রথমে কিছুটা অবাক হয়ে যান তিনি। নীচে জনতার ভিড়। সামাল দিচ্ছে বিশাল পুলিশ বাহিনী। অভিজ্ঞ রাজনীতিকের এর পরে অবশ্য বুঝতে অসুবিধা হয়নি কী হয়েছে। ফ্ল্যাটে পৌঁছেই দেখতে পেয়েছেন, তাঁর ঘরের বিভিন্ন জিনিসপত্র খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছেন তদন্তকারীরা। কিছুই বাদ যাচ্ছে না তল্লাশি থেকে।
ঘটনাস্থল বালির বাদামতলার একটি ফ্ল্যাট। যার মালিক বালি পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান সিপিএমের অরুণাভ লাহিড়ী। ঘুসুড়ি-ঘুষ কাণ্ডে মঙ্গলবার সেখানেই প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে তল্লাশি চালায় রাজ্য পুলিশের দুর্নীতি দমন শাখা। দুপুর আড়াইটে থেকে তল্লাশির কাজ শুরু করেন তদন্তকারীরা। তবে এ দিন স্রেফ তাঁর ফ্ল্যাটেই নয়, তল্লাশি চলে প্রাক্তন চেয়ারম্যানের শ্বশুরবাড়িতেও। ঘুষ-কাণ্ডে অভিযুক্ত বালি পুরসভার সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার প্রণব অধিকারী ও তাঁর ছেলেকে নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার পরে টানা জেরায় নাম উঠে এসেছিল সিপিএম নেতা অরুণাভবাবুর। এমনকী প্রণবাবুর ডায়েরিতেও একাধিক বার তাঁর নাম পাওয়া যায় বলে দাবি তদন্তকারীদের।
অরুণাভবাবুর শ্বশুরবাড়িতে দুর্নীতি দমন শাখার তল্লাশি।
গত শনিবার ওই সিপিএম নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যদিও সূত্রের দাবি, সেই জেরায় অরুণাভবাবুর বয়ানে বেশ কিছু অসঙ্গতি পান তদন্তকারীরা। এর পরে মঙ্গলবার সম্পত্তি ও ব্যাঙ্কের জমা খরচের হিসেবের নথি নিয়ে হাজির হতে বলা হয় তাঁকে। ইতিমধ্যে আদালত থেকে অরুণাভবাবু ও তাঁর শ্বশুরবাড়িতে তল্লাশির পরোয়ানা জারি করা হয়। সেই অনুযায়ীই এ দিন দুপুরে কলকাতায় দুর্নীতি দমন শাখার সদর দফতরে হাজির হয়েছিলেন অরুণাভবাবু।
কিন্তু ঠিক সে সময়ে দু’টি টাটা সুমো গাড়ি চড়ে পনেরো জনের এক তদন্তকারী দল হাজির হয় বাদামতলায় প্রাক্তন চেয়ারম্যানের ফ্ল্যাটের নীচে। প্রথমে গোটা বাদামতলা এলাকা ঘুরে দেখেন তদন্তকারীরা। সূত্রের খবর, শুধু এলাকার বিভিন্ন বহুতল পরিদর্শনই নয়, সেই নির্মাণে যুক্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কেও খোঁজ খবর নেন তাঁরা। তার পরে দু’ভাগে ভাগ হয়ে তদন্তকারীদের একটি দল উঠে যায় জিটি রোডের উপরে ওই আবাসনের চার তলায়। ওই তলাতেই অরুণাভবাবুর ফ্ল্যাট। অপর দলটি গিয়ে পৌঁছয় রাসবাড়ি এলাকায়, অরুণাভবাবুর শ্বশুরবাড়িতে। দু’জায়গাতেই একযোগে শুরু হয় তল্লাশি।
কী ঘটছে, প্রথমে তা টের পাননি এলাকাবাসী। কিন্তু খবর জানাজানি হতেই ক্রমশ ভিড় বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় বিশাল পুলিশ বাহিনী। দেড় ঘণ্টা তল্লাশির পরে বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ রাজ্য পুলিশের দুর্নীতি দমন শাখার আরও একটি গাড়ি অরুণাভবাবুর ফ্ল্যাটের নীচে এসে পৌঁছয়। সেই গাড়ি থেকে নেমে দুই অফিসারের সঙ্গে নিজের ফ্ল্যাটে উঠে যান অরুণাভবাবু। নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে প্রথমে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর বাড়িতে তল্লাশি হতে পারে আঁচ করতে পারলেও এত দ্রুত যে তদন্তকারীরা সেই কাজে হাত দেবেন, তা সম্ভবত বুঝতে পারেননি অভিজ্ঞ সিপিএম নেতাও।
প্রাক্তন চেয়ারম্যানের বাড়িতে তল্লাশি সেরে বেরিয়ে আসছেন অফিসারেরা।
এর পরেও তিন ঘণ্টা ধরে তাঁর সামনেই তল্লাশির কাজ চলে। হাফ হাতা আকাশি রঙের চেক জামা ও সাদা প্যান্ট পরে একটি চেয়ারে বসে তল্লাশির কাজ দেখেন অরুণাভবাবু। ঘন ঘন সিগারেট খাচ্ছিলেন তিনি। রাজ্য পুলিশের দুর্নীতি দমন শাখা সূত্রের খবর, তল্লাশির সময়ে অরুণাভবাবুর আলমারি থেকে বেশ কিছু গয়নার বাক্স পান তদন্তকারীরা। সেগুলি ছিল ফাঁকা। স্বভাবতই অরুণাভবাবুকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেন তদন্তকারীরা। তাঁদের দাবি, জবাবে অরুণাভবাবু জানান, গয়নার বিষয়টা বাড়ির মহিলাদের আওতায়। এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। অরুণাভবাবুর ব্যক্তিগত কম্পিউটারও খতিয়ে দেখেন তদন্তকারীরা। তাতে বেশ কিছু তথ্য নজরে এসেছে বলে দাবি তদন্তকারীদের।
তল্লাশি শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ। ততক্ষণে অবশ্য অরুণাভবাবুর চোখেমুখে কিছুটা স্বস্তির ছাপ। কারণ, রাজ্য পুলিশের দূর্নীতি দমন শাখা সূত্রের দাবি, অরুণাভবাবুর ফ্ল্যাট ও তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু ক্যাশ সার্টিফিকেট ও ব্যাঙ্কের নথি ছাড়া তেমন কিছু মেলেনি। তবে অরুণাভবাবুর বাড়ির কম্পিউটার থেকে বেশ কিছু তথ্য পেন-ড্রাইভে তুলে নিয়ে যান তদন্তকারীরা। তাঁরা চলে যাওয়ার পরে প্রশ্নের উত্তরে অরুণাভবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘তদন্তের স্বার্থে আমি কিছু বলব না। যা বলার, দুর্নীতি দমন শাখার অফিসারেরা বলবেন। তবে তদন্তে সব সময়ে আমি সহযোগিতা করছি, করবও। ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের যেন উপযুক্ত শাস্তি হয়।’’ দুর্নীতি দমন শাখার তরফে জানানো হয়েছে, অরুণাভবাবুর দেওয়া নথিও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
ঘুসুড়ি ঘুষ-কাণ্ডে নতুন করে আর কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। তবে সূত্রের দাবি, ফের অরুণাভবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। পাশাপাশি তদন্তে আরও বেশ কয়েক জন প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। তাঁদের শুধু জিজ্ঞাসাবাদই নয়, প্রয়োজনে তাঁদের বাড়িতেও তল্লাশি হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তদন্তকারীরা।
— নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy