দক্ষিণ কলকাতার একটি মিষ্টির দোকানে চলছে পাটিসাপ্টা বিক্রি। নিজস্ব চিত্র
হাতের কাছে কিছুই নেই তো কী! বাঙালির পৌষ সংক্রান্তিতে মেক্সিকান চিজ়, পিনাট বাটার আর ক্যালিফর্নিয়ার কিসমিসেই প্রবাসের পাটিসাপ্টা সৃষ্টি করেছেন চামেলি মজুমদার। জীবনের প্রথম ‘আমেরিকান পাটিসাপ্টা’। তাতে বিশেষ প্রাপ্তি, আদরের নাতির মুগ্ধ, বিস্ফারিত ডাগর দু’চোখ।
ঢাকায় শ্বশুরবাড়ির দেশে গোলপার্কের মেয়ে নয়না আফরোজের পৌষপার্বণের মেজাজও স্বমহিমায়। পাটিসাপ্টা, মুগপুলি, নারকেলি পাকন পিঠে, পায়েস! সেই সঙ্গে নৈশাহারে গরম গরম চিতুই পিঠে-যোগে গরগরে হাঁসের কালিয়ারও বন্দোবস্ত করেছেন। চালের রুটির আদলের চিতুই বা আস্কে পিঠেকে একদা বাঙালির প্রধান সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে ধরেছিলেন বরিশাইল্যা ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী। দক্ষিণ ভারতের জনজীবনে ইডলি বা আপ্পামের গুরুত্ব সর্বাঙ্গীন।
বাঙালির ক্ষেত্রে ঠিক সেটা ঘটেনি। তবু এ বারের পৌষ-পার্বণের এই আবহে মাঘের শুরুতেও পিঠে-সংস্কৃতি ছেয়ে আছে কলকাতাময়। অতিমারির দিনে শহরের পাড়ায় পাড়ায় পিঠে উৎসবের রমরমা কিছুটা ফিকে। তা-ও সমাজমাধ্যম বা বাঙালি মিষ্টির দোকানের ছবি, দুটোই স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে, পিঠে এখনও বাঙালির আবেগের কেন্দ্রস্থলে।
আদতে তামিলভাষী, বাঙালি বাড়ির বৌ দক্ষিণ কলকাতার পদ্মা আইয়ার রায়বর্ধনের কাছে এখন পোঙ্গলের মতো মকর সংক্রান্তিও কিছু কম নয়। পোঙ্গলের রকমারি নোনতা, মিষ্টি ভাতের মতোই সংক্রান্তির পিঠে সৃষ্টিতেও চৌকস পদ্মা। এ বার সংক্রান্তি ও পোঙ্গল ছিল একই দিনে। পোঙ্গল স্পেশাল মিষ্টি-মিষ্টি খিচুড়ি বা চক্কারা পোঙ্গলের সঙ্গে বন্ধুদের আবদারে পদ্মাকে নারকেল পিঠেও বানাতে হয়েছে।
শুধু পাটিসাপ্টা নয়, এই মরসুমে বাঙালি ময়রাও পিঠেয় মজেছে। জানুয়ারির অন্তত প্রথম তিন সপ্তাহ ধরেই জারি থাকবে বাঙালি ময়রার পিঠে পার্বণ।
“মিষ্টির দোকানে ঘরোয়া পিঠে তৈরি নিয়ে আগে কিছু কুসংস্কার কাজ করত বিক্রেতাদের মধ্যে। কিন্তু পিঠের চাহিদা, গেরস্ত বাঙালির পিঠে তৈরির সময়াভাব— সব মিলিয়েই পৌষপার্বণের বাজার ধরাটা এখন জরুরি’’, বলছিলেন ভবানীপুরের বলরাম ময়রার উত্তরপুরুষ সুদীপ মল্লিক। ঝকঝকে মিষ্টির দোকান, তাতে পাটিসাপ্টা বা আস্কে পিঠের প্লেটে গ্লাভস পরা হাতে হাতায় উপচে পড়া নলেন গুড় ঢালার দৃশ্যটিও বলরামের মতো কিছু দোকানের সৌজন্যে বাঙালির নাগরিক-জীবনের অঙ্গ। পিঠের সঙ্গে মালপো তো অনেক দোকানে বছরভরই থাকে। সেই সঙ্গে ঢুকে পড়ছে ভাপা পিঠে, দুধপুলি, রসবড়া, মুগসামলি, রাঙা আলুর পিঠে, গোকুলপিঠে, সরু চাকলি বা নোনতা কী ঝাল পিঠের মতো সৃষ্টিও। এই পিঠে-যজ্ঞের জন্য বলরামের ভেনঘরে নির্দিষ্ট কারিগর-বাহিনী রয়েছে। কিন্তু তরুণ মিষ্টি বিক্রেতাদের একাংশের মঞ্চ, ‘মিষ্টি উদ্যোগ’-এর মাধ্যমে পিঠে উৎসবে বাঙালি গৃহিণীর প্রতিভাও মেলে ধরা হচ্ছে।
জানুয়ারি মাস জুড়েই দোকানে জারি রকমারি পিঠে-যজ্ঞ। কে সি দাশ, মিঠাই, বাঞ্ছারাম, গার্ডেনরিচের সতীশ ময়রা, মৌচাক, বড়বাজারের শ্রীকৃষ্ণ, হাওড়ার ব্যাতাই সুইটস, ব্রজনাথ বা রিষড়ার ফেলু ময়রা, চন্দননগরের সূর্য মোদক— অনেকেই পিঠে-সম্ভার নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। গার্ডেনরিচ এলাকার একটি সংস্থার সুবাদে স্থানীয় কয়েক জন দুঃস্থ মহিলা এখন দিনভর বিভিন্ন ময়রার হেঁশেলে পড়ে থেকেই পিঠে সৃষ্টিতে ব্যস্ত।
সতীশ ময়রার দোকানের সম্রাট দাস জানালেন, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ১০ থেকে ১২ রকমের পিঠে হচ্ছে। পুজো থেকে শুরু করে গত বছরের শেষ পর্যন্তও মিষ্টি-কারবার ২৫-৩০ শতাংশ খারাপ যাচ্ছিল বলে আফশোস মিষ্টি-স্রষ্টাদের। নলেন গুড়ের সঙ্গে পিঠের যোগফলে সেই দুঃসময় কেটেছে বলে তাঁদের দাবি। গিন্নিরা পিঠের সৌজন্যে প্রতিভার দাম পাচ্ছেন, এটাও অনেকে সদর্থক চোখে দেখছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy