প্রতিষেধক নিচ্ছেন এক মহিলা। নিজস্ব চিত্র
করোনার প্রতিষেধকের দু’টি ডোজ়ই নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। তার দিন ২০ পরে হাল্কা জ্বর-সহ কিছু উপসর্গ দেখা দিতেই সন্দেহ হয়েছিল এক চিকিৎসকের। তড়িঘড়ি আরটিপিসিআর পরীক্ষা করাতেই রিপোর্ট এল, ‘কোভিড পজ়িটিভ!’ তবে ওই চিকিৎসক বলছেন, ‘‘এর মধ্যে বৈজ্ঞানিক নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম নেই। প্রতিষেধক নেওয়ার পরেও কিছু মানুষের করোনা হতে পারে। কিন্তু করোনাকে রুখে দিতে চাইলে সবাইকে প্রতিষেধক নিতে হবে। এটাই একমাত্র পথ।’’
করোনাকে প্রতিহত করতে প্রতিষেধক নেওয়ার উপরে জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। রাজ্য জুড়ে প্রতিদিন অন্তত এক লক্ষ মানুষকে প্রতিষেধক দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রতিষেধকের দু’টি ডোজ় নেওয়ার কয়েক দিন পরেই, কেউ আবার দু’সপ্তাহ পরেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, এমন খবরও প্রকাশ্যে আসছে। তাতে এক শ্রেণির মানুষের প্রশ্ন, ‘‘প্রতিষেধক নিলেও যদি করোনা হয়, তা হলে প্রতিষেধক নিয়ে লাভ কী?’’ তবে সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ থেকে চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘‘এক শ্রেণির মানুষের ঢিলেঢালা মনোভাব ফের বিপদ ডেকে এনেছে। তেমনই প্রতিষেধক নেওয়ার পরেও কেন করোনা হবে— এই প্রশ্ন তুলে আরও বিপদ বাড়াচ্ছেন অন্য এক শ্রেণির মানুষ। মনে রাখতে হবে, করোনা আটকাতে মাস্ক এবং প্রতিষেধকই একমাত্র অস্ত্র।’’
কিন্তু প্রতিষেধক নেওয়ার পরেও কেউ কেউ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন কেন? রাজ্যের কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্কের উপদেষ্টা, চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী বলছেন, ‘‘পৃথিবীতে কোনও প্রতিষেধকের কার্যকারিতাই ১০০ শতাংশ নয়। সাধারণ ভাবে প্রতিষেধক নেওয়ার পরেও এক চতুর্থাংশ মানুষের সংক্রমণ হতে পারে। কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে প্রতিষেধকের দু’টি ডোজ় নেওয়ার দু’সপ্তাহ পরেও যদি করোনা হয়, তাতে মারাত্মক সংক্রমণের আশঙ্কা অনেক কম।’’ তাই প্রতিষেধকের কার্যকারিতা নিয়ে অহেতুক ও অবৈজ্ঞানিক প্রশ্ন তোলা উচিত নয় বলেই দাবি চিকিৎসকদের। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, প্রতিষেধকের দ্বিতীয় ডোজ় নেওয়ার পরে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে যাঁদের এমন হচ্ছে, তাঁদের সম্পর্কে নথি রাখা হচ্ছে।
রাজ্যে প্রতিষেধকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফেসিলেটর স্নেহেন্দু কোনার জানাচ্ছেন, তৃতীয় পর্যায়ের গবেষণার পরে দেখা গিয়েছে, কোভিশিল্ডের ক্ষেত্রে এফিকেসি রেট বা কার্যকারিতার হার ৬৫-৭০ শতাংশ। কোভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে সেটি ৮০-৮১ শতাংশ। ফলে যাঁরা কোভিশিল্ড নিয়েছেন, তাঁদের ৩৫ থেকে ৩০ শতাংশ এবং কোভ্যাকসিন নেওয়া ২০-১৯ শতাংশ মানুষের করোনা হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। কিন্তু তার ফল মারাত্মক হয় না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক অনির্বাণ দলুইয়ের কথায়, ‘‘প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, প্রতিষেধক নেওয়ার পরে বেশ কিছু মানুষ কোভিড-বিধি মানছেন না। এই মিথ্যা সন্তুষ্টিবোধ বিপদ ডেকে আনছে। যে হেতু কোভিড প্রতিষেধকগুলি কোনওটাই ১০০ শতাংশ সুরক্ষা দেয় না, তাই প্রতিষেধক নিলেই মাস্ক খুলে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুরে বেড়ানো ঠিক নয়।’’
ইমিউনোলজিস্ট দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, প্রতিষেধকের প্রথম ডোজ়ের পরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় না। দ্বিতীয় ডোজ় নেওয়ার ১৫ দিন পরে সেটি তৈরি হয় বলেই আশা করা যায়। কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া সব মানুষের ক্ষেত্রে সমান নয়, তাই কারও ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় লাগতে পারে। মাঝের এই সময়ে প্রতিষেধক নেওয়ার আত্মতৃপ্তিতে বিধি না মেনে চলার ফলেই সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘‘প্রতিষেধক শরীরে ঢুকে ইমিউনো সিস্টেমকে আগে থেকে ভাইরাসটিকে চিনিয়ে রাখে। যাতে শরীরে ভাইরাসটি ঢুকলেই প্রতিষেধকটি কাজ শুরু করতে পারে।’’
তাঁর মতোই অন্য চিকিৎসকদের ব্যাখ্যা, ধরা যাক, এক দুষ্কৃতী এলাকায় ঢুকেছে। কিন্তু মানুষ তাকে চেনেন না। ফলে খারাপ অথবা ভাল বোঝার আগেই সে নিজের দাপট শুরু করে দেবে। কিন্তু আগে থেকে যদি ওই দুষ্কৃতীর মুখটা চেনা থাকে, তা হলে এলাকায় ঢোকা মাত্রই তাকে প্রতিহত করতে এগিয়ে আসবেন মানুষ। এটাই হচ্ছে প্রতিষেধকের কাজ। মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বলছেন, ‘‘প্রতিটি মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সমান নয় বলেই যত সমস্যা। কারও সেটা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে তাড়াতাড়িই নষ্ট হয়। কারও ধীরে তৈরি হয়ে অনেক দিন পর্যন্ত থাকে। প্রতিষেধক নেওয়ার আগে এবং পরে আক্রান্ত হওয়ার মধ্যে একটা তফাত রয়েছে। প্রতিষেধক নেওয়া থাকলে ফুসফুস, লিভার, হৎপিণ্ড, কিডনিতে গুরুতর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা অত্যন্ত কম।’’
তাই প্রতিষেধক নিয়ে অহেতুক আতঙ্ক না বাড়িয়ে, হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তুলতে সকলেরই সেটি নেওয়া উচিত বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy