বেপরোয়া: নাগেরবাজার থানার সামনে দিয়ে ডিজে বাজিয়ে প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রা। বৃহস্পতিবার রাতে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।
পুলিশকে জানানো হয়েছে এক রাস্তার কথা, আর বিসর্জনের শোভাযাত্রা যাচ্ছে অন্য রাস্তা দিয়ে। তা-ও বহু লোকজন এবং বাজনা সহযোগে। প্রতিমার উচ্চতাও প্রায় ১৭ ফুটের কাছাকাছি। কিছু দূর এগোতে না এগোতেই ওই শোভাযাত্রা নিয়ে অন্য এক পুজো কমিটির সঙ্গে বচসা শুরু। অভিযোগ, যে রাস্তা দিয়ে প্রতিমা এগোচ্ছে, সেখানেই রয়েছে একের পর এক বিজ্ঞাপনী গেট! সেগুলি খুলে না ফেললে এত উঁচু প্রতিমা নিয়ে এগোনো অসম্ভব!
যে পুজো কমিটির গেট আর যাঁরা প্রতিমা নিয়ে এগোচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে এর পরে বচসা কার্যত হাতাহাতির পরিস্থিতিতে পৌঁছয়! কেন আগে থেকে জানানো হয়নি, কেন পুলিশ জানে না, এ নিয়ে যখন তীব্র বাদানুবাদ চলছে, তখনই ক্ষমতা প্রদর্শনে নামেন প্রতিমা নিয়ে বেরোনো পুজো কমিটির এক কর্তা। ফোন করে দ্রুত পুরসভার গাছ কাটানোর একটি গাড়ির ব্যবস্থা করেন তিনি। লেক রোড এবং লেক ভিউ রোডের পর পর চারটি বিজ্ঞাপনী গেট কাটানো হয় ওই গাড়ি দিয়ে। অভিযোগ, সেগুলি নামিয়ে কার্যত দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে এগোয় শোভাযাত্রা। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়।
লেক ভিউ রোডের সংশ্লিষ্ট পুজো কমিটি, সমাজসেবী সঙ্ঘের তরফে তাদের বিজ্ঞাপনী গেট ভেঙে দিয়ে ক্ষমতা প্রদর্শন করা হয়েছে বলে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। অভিযোগ পৌঁছয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও। পুজোকর্তা অরিজিৎ মৈত্রের মন্তব্য, ‘‘কোন পুজোর প্রতিমা কোন পথে নিরঞ্জনের জন্য যাবে, সেটা আগাম পুলিশকে জানানোর নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সেই নিয়ম ভেঙে কাউকে কিছু না জানিয়ে আমাদের মতো এত পুরনো পুজোর গেট ভেঙে দিয়ে চলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে কী করে? তবে কি বিসর্জনের কোনও নিয়ম মানা হচ্ছে না?’’
এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শহর জুড়ে এমনই বহু অভিযোগ সামনে আসছে। বুধবারের পরে যা সব চেয়ে বেশি এসেছে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। শুক্রবারও যার বিরাম
ছিল না। বহু ক্ষেত্রেই নিয়মের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না বলে ভুক্তভোগীদের দাবি। সব চেয়ে বেশি অভিযোগ আসছে শোভাযাত্রায় যাওয়ার নামে গাড়ি এবং মোটরবাইকের ট্র্যাফিক বিধি-ভঙ্গের। অধিকাংশই হেলমেট পরার নিয়মটুকুও মানার তোয়াক্কা করেননি বলে অভিযোগ। পাল্লা দিয়ে চলেছে শব্দ-তাণ্ডব! অভিযোগ, আদালতের নির্দেশ অমান্য করে যেমন নিষিদ্ধ শব্দবাজি ফাটানো হয়েছে কিছু জায়গায়, তেমনই দেদার বেজেছে বিশাল মাপের সাউন্ড বক্স। পুলিশ-প্রশাসনের নির্দেশ উড়িয়ে লরিতে নকল ‘ডিস্কথেক’ বানিয়ে ডিজে বক্স বাজানোও চলেছে যখন-তখন। অনেকে আবার আইনের ফাঁদ এড়াতে ‘তাসা পার্টি’র ব্যবস্থা করেছিলেন। যদিও প্রতি বারের মতো এ বারও পুজোকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় বৈঠকে ডিজে বক্স বা উচ্চ শব্দতরঙ্গ যুক্ত বাজনা না বাজানোর নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা পুলিশ। তার পরেও পুলিশকর্মীদের অধিকাংশকেই কার্যত দর্শকের ভূমিকায় দেখা গিয়েছে বলে অভিযোগ। এর মধ্যে নাগেরবাজার এলাকায় ডিজে বক্স বাজানো বন্ধ করতে যাওয়া পুলিশকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভের ঘটনাও ঘটেছে। চলেছে থানা ঘেরাও-ও! সেখানে অবশ্য রাশ আলগা করেনি পুলিশ।
গত তিন দিনে বাবুঘাট চত্বরের পরে বিসর্জনের চাপ সব চেয়ে বেশি ছিল মানিকতলা মেন রোড, বিডন স্ট্রিট, অরবিন্দ সরণি, গ্রে স্ট্রিট এবং রবীন্দ্র সরণিতে। সন্ধ্যা ছ’টার পরে ওই সব রাস্তায় যান চলাচল কার্যত থমকে যায়। দক্ষিণ কলকাতার বহু প্রতিমা এই সময়ে বাবুঘাটের দিকে আসায় ধর্মতলা এবং হেস্টিংস থানা চত্বরের বেশ কিছু রাস্তায় যানজট তৈরি হয়। অরবিন্দ সরণিতে এই সময়েই দেখা যায়, জনা পনেরো সদস্যের তাসা পার্টি চলেছে। তাদের বাজনার আওয়াজে কান পাতা দায়। কিছু দূরেই দেখা যায়, রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছেন একটি পুজোর কয়েক জন সদস্য। তাঁদের ঘিরেই ঝুঁকে পড়ে নাচ চলছে অন্যদের। যে গানে নাচ চলছে, সেটি বাজছে লরির উপরে। তার চার দিকেই বড় বড় বক্সগুলি লাগানো হয়েছে। শোভাবাজার স্ট্রিটের কাছে এমনই শোভাযাত্রা দেখে এক মাঝবয়সি ব্যক্তি বললেন, ‘‘আমার বাবার হার্টের সমস্যা। এই সময়ে আমাদের অরবিন্দ সরণির বাড়িতে বাবাকে রাখা যায় না। গভীর রাত পর্যন্ত তারস্বরে বক্স বাজে।’’ বিডন স্ট্রিটের আর এক বাসিন্দার মন্তব্য, ‘‘ঘরের ভিতরে গেলেই বুঝতে পারবেন গোটা বাড়ি কেমন কাঁপছে! জানলার কাচগুলো যেন ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ে যাবে! কাউকে অভিযোগ করেও লাভ নেই।’’
এমন শব্দ-তাণ্ডব চালাতে চালাতে বিসর্জনের শোভাযাত্রা যেতে দেওয়া হচ্ছে কেন, এই প্রশ্ন শুনে নিমতলার কাছে এক পুলিশকর্মী বলেই দিলেন, ‘‘পুজোটা দারুণ কেটেছে। বাহিনীর কেউই যাতে বিতর্কে জড়িয়ে না পড়েন, সেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে উপরমহল থেকে। যতটা সম্ভব বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কার্যোদ্ধার করতে বলা হয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy