উদ্বিগ্ন: বাড়ি ছাড়তে না হলেও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন পুলক ও প্রণতি লাহা। সোমবার। নিজস্ব চিত্র
গভীর রাতেও ঘুম নেই রুনু চক্রবর্তী বা রাজকুমার তিওয়ারিদের। দুর্গা পিতুরি লেনের মুখে রবিবার রাত দু’টোতেও ঠায় দাঁড়িয়ে কাছাকাছি গলির বাসিন্দা দু’টি পরিবার। দস্যি নাতিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রুনুদেবী বলে চলেছেন, ‘‘আমরা তো ঠিক উল্টো দিকেই থাকি। ভয়ে বাড়ির ভিতরে শুতে পারছি না। আমাদের কিছু ক্ষতি হবে না তো!’’
মেট্রো রেলের গাড়ি থেকে অতিকায় সব যন্ত্রপাতি ক্রেনে ঝুলিয়ে নামানো চলছে। কোনটার কী কাজ তা নিয়ে চলছে পাড়ার লোকজনের জল্পনা। সেই ভিড়েই দাঁড়িয়ে ‘অভিশপ্ত গলি’র বাসিন্দা পুষ্পেন্দু হালদার বা দীপঙ্কর দত্তেরা। চাঁদনি চকের হোটেলে সপরিবার ঠাঁই পেয়েছেন পুষ্পেন্দুবাবু। দীপঙ্করবাবু রয়েছেন দাদার বাড়িতে। সোমবার বিকেলে পুষ্পেন্দুবাবু মেট্রোর আধিকারিকদের কাছে দরবার করতে ব্যস্ত। দীপঙ্করবাবু গলির মুখ থেকে গোয়েন্কা কলেজের কন্ট্রোল রুমে যাতায়াত করে চলেছেন।
এত বড় সুড়ঙ্গের কাজের আগে গলির জমি পরীক্ষা কি সত্যিই ঠিক মতো হয়েছিল? রবিবার রাত সওয়া ১২টায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে দেখে প্রশ্ন হাফপ্যান্ট-পরা মাঝবয়সির। আশ্বস্ত করে বাবুলের দুঃখপ্রকাশ! ‘‘এত বড় ধাক্কা ভাবিইনি! সুড়ঙ্গ আর ১৫০ মিটার এগোলে শিয়ালদহ স্টেশন! গঙ্গার তলা, হাওড়া স্টেশনের কারশেড পার করে বৌবাজারে কেন যে এমন হল?’’— বলছিলেন বাবুল।
লীলাদেবী গুপ্ত ও রাণু গুপ্ত। সোমবার। নিজস্ব চিত্র
সোমবার দুপুরে সেখানেই জনরোষের মুখে পড়লেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়। বেলা সাড়ে ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত চলল অবরোধ। দুর্গা পিতুরি লেন ও সেকরাপাড়া লেন— রবিবার সন্ধ্যা থেকে দু’টি গলির মুখেই পুলিশি ব্যারিকেড। সন্ধ্যায় সেকরাপাড়া লেনের দিক থেকে ছুটে এসে পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের আধিকারিকেরা জানান, রাস্তা ফাটছে। এর পরেই তড়িঘড়ি ‘ইমার্জেন্সি লাইট’ বসায় পুলিশ।
দুর্গা পিতুরি লেনে ভেঙে পড়া শীল-বাড়ি, বড়াল-বাড়ি বা জয়সওয়াল পরিবারের বাড়ির সামনে গার্ডরেল রেখে দিয়েছে পুলিশ। রাত জাগছেন দমকলকর্মী, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যেরা। গলির রাস্তায় ইঁদুরেরও নড়াচড়া। পুষ্পেন্দুবাবু জানান, কোনও ভাবে পুলিশকে বলে মেয়ের মাধ্যমিকের মার্কশিট আনতে বাড়িতে ঢুকেছিলেন। সকলেরই দুশ্চিন্তা, দিনে গাড়ি চললে রাস্তা যদি আরও বসে যায় তাই নিয়ে। রাতভর মেট্রোকর্তারা মাপ নিয়ে দেখেছেন কতটা রাস্তা বসছে।
সোমবার সন্ধ্যায় মেট্রোকর্তারা জনতাকে বোঝাচ্ছিলেন, সুড়ঙ্গে জল ঝরা বন্ধ করতে বিদেশি ভূ-পদার্থবিদেরা বৈঠক করছেন। বাসিন্দারা চিন্তায় কবে বাড়ি ফিরবেন তা নিয়েও। যাঁরা এখনও নিজেদের বাড়িতে রয়েছেন তাঁরাও নিশ্চিন্ত নন কত দিন থাকতে পারবেন। সেকরাপাড়া লেনের বছর ছিয়াশির বৃদ্ধ পুলকচন্দ্র লাহা বলেন, ‘‘আমাদের বাড়ির ঠিকানা পাঁচ নম্বর সেকরাপাড়া লেন। ঠিক পাশের বাড়িতেই ফাটল ধরেছে। ওই বাড়ি ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের বাড়ি খালি করতে বলা হয়নি ঠিকই, তবু আতঙ্কে, দুশ্চিন্তায় গত কয়েক দিন ধরে বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছি।’’ তিনতলা বাড়িটিতে থাকে পুলকবাবুদের যৌথ পরিবার। ক্ষুব্ধ পুলকবাবুর প্রশ্ন, ‘‘মেট্রোর ইঞ্জিনিয়ারেরা আগাম সতর্কবার্তা দিতে পারলেন না কেন? তাঁদের কর্তব্যে গাফিলতির জেরেই আজ এই অবস্থা।’’
সেকরাপাড়া লেনের বহু বাসিন্দাই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। লীলাদেবী গুপ্ত নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা সোমবার বললেন, ‘‘আমাদের সরতে হয়নি ঠিকই। কিন্তু ভয়ের চোটে মাঝেমধ্যেই পরীক্ষা করে দেখছি দেওয়ালে কোথাও ফাটল ধরছে কি না।’’ লীলাদেবীর বাড়ির সিঁড়ি বা বারান্দা যাতে ভেঙে না পড়ে, তার জন্য মেট্রো কর্তৃপক্ষ কাঠের খুঁটি দিয়ে ঠেকনা দিয়ে রেখেছেন। সেকরাপাড়া লেন লাগোয়া গৌর দে লেনের বাসিন্দা অলোককুমার দাস বলেন, ‘‘সকাল থেকে দেখছি, আমাদের বাড়িতেও ফাটল ধরেছে। দেওয়াল হেলে পড়ায় দরজা লাগাতে পারছি না। কত দিন এই ভাবে থাকতে পারব, জানি না।’’
সেকরাপাড়া লেনের বেশির ভাগ বাড়িই এখন খালি। এলাকার বাসিন্দা প্রণতি লাহা বললেন, ‘‘উত্তর কলকাতার এই সমস্ত এলাকায় আমরা প্রতিবেশীদের সঙ্গে ছাদে দাঁড়িয়েই গল্প করি। ওঁরা কেউ নেই। কবে ওঁরা ফিরবেন, সেই আশাতেই রয়েছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy