Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Self-control

নিজে সংযমী হয়ে সন্তানকে সংযমের শিক্ষা দিন

এই বছরটা অন্তত উৎসবে নিজেদের নির্লিপ্ত রাখার চেষ্টা করা যাক। তার বদলে আমাদের সন্তানদের উৎসাহ দিই সামাজিক কর্তব্য পালনে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

পায়েল ঘোষ (পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট)
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২০ ০৩:৫৩
Share: Save:

চিত্র ১: সাত বছরের সৌমিকের মন ভালো নেই আজকাল। কত দিন ধরে মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি ওর। হাসপাতাল থেকে শুধু ভিডিয়ো কলে মায়ের সঙ্গে কথা হয়। মা বলেছিল, পুজোর সময়ে বাড়িতে ফিরবে। তাই মনে মনে সৌমিক অনেক কিছু ভেবে রেখেছিল। কিন্তু একটু আগে মা ফোনে জানিয়েছে, পুজোর সময়েও আসতে পারবে না। কোভিড রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে অনেক। তাই মায়ের ছুটি বাতিল হয়ে গিয়েছে। বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সৌমিক। রাস্তায় লোকজন হেঁটে যাচ্ছে মাস্ক ছাড়া। পাশের বাড়ির কাকুরা অনেক জন মিলে হইহই করে কেনাকাটার পরে ফিরল। সৌমিকের মন আরও খারাপ হয়ে গেল। মা বলছিল, মাস্ক না পরা, ভিড়ের মধ্যে কেনাকাটা করতে গিয়েই বেড়ে যাচ্ছে কোভিড। এদের জন্যই কি মা বাড়ি আসতে পারবে না পুজোর সময়ে?

চিত্র ২: সোহিনীর সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিল ওর বাবা। বাবার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলার মজাই ছিল আলাদা। সময় পেলেই রাতে তারা দেখানো বা পড়াশোনার যাবতীয় দরকারে সে বাবাকে পাশে পেত। কিন্তু এখন বাবার ছবিটাই সম্বল ওর। এক মাস আগে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তিনি। সোহিনীর মাঝেমাঝেই মনে হয়, প্রশাসনিক পদে থাকা বাবার এমন ভাবে আকস্মিক মৃত্যু হত না যদি সাধারণ মানুষ কোভিড নিয়ে একটু সচেতন হতেন।

সোহিনী বা সৌমিকের মতন অনেক বাচ্চারাই অভিভাবকদের সান্নিধ্যের অভাবে মানসিক কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। মনে রাখা বিশেষ প্রয়োজন, এর জন্য আমরা সকলেই অনেকাংশে দায়ী। সুঅভিভাবকত্বের প্রাথমিক শর্ত হল সন্তানকে মূল্যবোধ এবং সহানুভূতিশীলতার পাঠ দেওয়া। সেই পাঠ শুধু গল্প বা বক্তৃতার মাধ্যমে নয়, নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে শেখানোর মাধ্যমেই পূর্ণতা পেতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের মধ্যে এ বিষয়ে বিপরীতধর্মী আচরণ দেখা যায়।

প্রশাসনিক তৎপরতার জেরে গত প্রায় সাত মাস ধরে আমরা সবাই খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে কম বেরিয়েছি। স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে সংক্রমণের ভয়ে। জীবনের সাথে যাপন করতে শিখেছি স্বাস্থ্য-বিধি। উদ্দেশ্য একটাই, আমি এবং আমার পরিজনেরা যেন সুস্থ থাকে।

কিন্তু উৎসবের মরসুম পড়তে না পড়তেই সে সংযমের বাঁধ উধাও। কিছু দিন আগে অবধি যে শিশুটিকে অভিভাবক বাড়ির নীচের ফাঁকা জায়গায় সাইকেল পর্যন্ত চালাতে দিচ্ছিলেন না, আজ তারই হাত ধরে ভিড়ে ঠাসা শপিং মলে কেনাকাটা করতে বেরিয়ে পড়েছেন। স্বাস্থ্য-বিধির ঊর্ধ্বে গুরুত্ব পাচ্ছে খামখেয়ালিপনা। স্বাস্থ্যকর্মীরা বারবার সাবধান করা সত্ত্বেও সামাজিক দূরত্ব-বিধির তোয়াক্কা না করে জমায়েত বা কেনাকাটা চলছে পুরোদমে। এই সাময়িক আত্মসুখের জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষ যে আবার চরম শারীরিক-মানসিক সঙ্কটে পড়তে পারেন, সেই দিকটিকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব তো আমরা দিচ্ছিই না, উপরন্তু আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছি সন্তানদের।

এ প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে লকডাউন শুরুর সময়ের কথা। তখন অর্থনৈতিক ভাবে সবল বেশ কিছু পরিবার এত বেশি পরিমাণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাড়িতে মজুত করে রেখেছিলেন যে সাধারণ মানুষ দোকানে গিয়ে জিনিস পাননি। অথচ ‘সকলের তরে সকলে আমরা’— এই লাইনটি ছোট থেকে নীতিবিজ্ঞানের বইতে পড়েছি। এই কঠিন পরিস্থিতিতে যদি তার সদ্ব্যবহারই না করতে পারলাম, তাহলে কী-ই বা রেখে যাব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য?

তাই নিজেরা সংযমী হয়ে সন্তানকে সংযমের শিক্ষা দিন। এই বছরটা অন্তত উৎসবে নিজেদের নির্লিপ্ত রাখার চেষ্টা করা যাক। তার বদলে আমাদের সন্তানদের উৎসাহ দিই সামাজিক কর্তব্য পালনে। এই উৎসবের মরসুমে ওদের হাতে বানানো কার্ড, আঁকাজোকা, গান বা কবিতা পৌঁছে দিই সেই সকল স্বাস্থ্যকর্মী বা প্রশাসনের মানুষজনের কাছে, যাঁরা সমাজকে কোভিডমুক্ত করার গুরুদায়িত্ব সামলাচ্ছেন প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। মনে রাখবেন, আপনার-আমার হাত ধরেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিখবে সামাজিক দায়িত্ব ও সহমর্মিতার পাঠ।

অন্য বিষয়গুলি:

Parents self-control covid 19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy