Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus in Kolkata

Coronavirus: চোখ থাকতেও আমরা অন্ধ আতশবাজি হব কেন?

চাকরি চলে যাওয়া কর্মী থেকে শুরু করে ব্যবসার গণেশ উল্টে ফেলা ক্ষুদ্র উদ্যোগী পর্যন্ত পথে না নামলে ক’দিন আগে বড়দিনে ওই রাক্ষুসে ভিড় হয় না।

ট্রানজ়িট ক্যাম্পে দু’জনের করোনা ধরা পড়ায় অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হচ্ছে। শুক্রবার, বাবুঘাটে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

ট্রানজ়িট ক্যাম্পে দু’জনের করোনা ধরা পড়ায় অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হচ্ছে। শুক্রবার, বাবুঘাটে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় (সাহিত্যিক)
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৩৯
Share: Save:

গৌতম বুদ্ধের কথা আবারও সত্য হয়ে উঠল। মৃত্যু প্রবেশ না-করা বাড়ির থেকে শস্য সংগ্রহ যেমন অসম্ভব, তেমন কারও করোনা হয়নি, এমন পরিবার খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর হয়ে উঠছে। আমি নিজে আমার চার জন আত্মীয়কে হারিয়েছি এই অতিমারিতে, তাঁদের মধ্যে এক জনের বয়স চল্লিশের নীচে। ছোটবেলায় বাবা এলটিসি পেলে পুরী নিয়ে যেত, একটা ঢেউ গিয়ে আর একটা আসার ফাঁকেই কয়েকটা ঝিনুক কুড়িয়ে নিতাম। এখন ঢেউয়ের আসা আর চলে যাওয়ার ভিতরে অনেক মৃতদেহ কুড়িয়ে নেওয়ার পালা, তাদের কেউ আগুনে যাবে, কেউ বা গঙ্গায়।

তার মধ্যে এত ফুর্তির কারণ কী, কেউ জানে না! সেই ফুর্তির হোতা যে কেবল ঘরে বসে মাইনে পাওয়া শ্রেণি, তা কিন্তু নয়। চাকরি চলে যাওয়া কর্মী থেকে শুরু করে ব্যবসার গণেশ উল্টে ফেলা ক্ষুদ্র উদ্যোগী পর্যন্ত পথে না নামলে ক’দিন আগে বড়দিনে ওই রাক্ষুসে ভিড় হয় না। শ্মশানবৈরাগ্যের বিপ্রতীপে শ্মশান-অবজ্ঞার একটা বোধ চারিয়ে গিয়েছে সম্ভবত। আইরিশ কবি লুই ম্যাকনিসের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ছিল ‘ব্লাইন্ড ফায়ারওয়ার্কস’। কম-বেশি প্রত্যেকেই যেন হয়ে উঠছি সেই অন্ধ আতশবাজি, যা বাবা জ্বালায় আর সন্তানের গায়ে গিয়ে লাগে। আসলে অনুরণন বন্ধ, তাই অনুসরণে অন্ধ। ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এর নাট্যকার সেই কবে লিখে গিয়েছেন, ‘‘কেন তুমি দেবে তুড়ি, ওরা যদি তোলে হাই?/সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই’’।

কে দাদা, বাদল সরকার? আমরা রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকারদের কথাই বলে শুনি না! নইলে ২৫ তারিখে ওই আকাশ-পাতাল ছাপানো ভিড়ের পরে যখন তৃতীয় ঢেউ কড়া নাড়ছে দরজায়, তখন আবার পয়লা জানুয়ারি শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে বেরিয়ে পড়ি? অবশ্য সরকারই বা যায় কোথায়, পয়লা জানুয়ারি মদের দোকান খোলা না রাখলে রাজস্ব আসবে কোত্থেকে? অতএব পম্পেই ধ্বংস হোক বা হিরোশিমায় বোমা পড়ুক, বিলাইতির দোকান খুলে রাখা অবশ্য কর্তব্য!

কর্তব্যের ঠেলায় মরার লাইনে সবার সামনে ইট পেতেছেন নার্স আর ডাক্তারেরা। যদিও দ্বিতীয় দলের অনেক বদনাম, এমনকি যে রোগী বেঁচে ওঠেন, তিনিও পারলে জীবনমুখী ‘ও ডাক্তার’ গাইতে গাইতে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। তবু যত বার করোনার সৌজন্যে ‘চলো পটল তুলি’ মঞ্চে আসে, ওঁদের এগোতেই হয়।

আমরা একটু পিছু ফিরে দেখতে শিখব কবে? নদীতে লাশ ভাসছিল, অক্সিজেন না পেয়ে ঘরে ঘরে দাপাচ্ছিল মানুষ, বেশি দিন আগের কথা তো নয়। কিন্তু চার মাসের মাথায় পুজো আসতেই কোথায় স্লোভাকিয়ার জিমন্যাস্টের আদলে প্রতিমা হয়েছে আর কোথায় হনোলুলুর সুইমারের ঢঙে, দেখার ঢল পড়ে গেল। বুর্জ খলিফা খায় না মাথায় দেয় জানা নেই, লক্ষাধিক লোক বাইপাসে নেমে পড়ল। অকালবোধন করেছিলেন রামচন্দ্র, তাঁর জীবনের সিকিভাগ কেটে গেল দণ্ডকারণ্যে বিপুল সামাজিক দূরত্বে আর আমাদের গঙ্গারাম সেলফি নেওয়ার বাহানায় নিজের মাস্কবিহীন মুখ এগিয়ে নিয়ে গেল আরও কত মাস্ক না-পরা মুখের দিকে। পরিণাম, স্কুল-কলেজ আবার বন্ধ, ওষুধের দোকানে অক্সিজেনের আকাল, অ্যাজিথ্রোমাইসিন অমিল।

জিজ্ঞাসা আসতেই পারে, অমলের মতো ঘরে বন্দি হয়ে দইওয়ালার দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে হবে নাকি? উত্তর হল, এখন তো ‘ভার্চুয়াল’, ‘রিয়্যাল’-এর চাইতে ঢের মনোগ্রাহী। কয়েকটা দিন সুধার সঙ্গে ফোনে কথা হলেই বা ক্ষতি কী? আর কিছু মনে না থাক, লকডাউনের কালবেলায় পিসেমশাইয়ের ব্যবসা প্রায় লাটে উঠেছে, ককটেল জ্যাব কেনা দুঃসাধ্য, এটুকু মনে রাখাই যায়। যাঁরা নিয়ম মেনে অতিমারির সঙ্গে লড়ার চেষ্টা করছেন, তাঁদের কাছে, প্যাটিস আর পিৎজ়া খাওয়ার জন্য আধ ঘণ্টা মাস্ক না পরলে কী ক্ষতি বা হকারেরা মাস্ক পরে ট্রেনে উঠছেন কি না, প্রশ্নগুলো দুর্ভাগ্যবশত এখনও আসে। উত্তরে মুনির নিয়াজির দু’টি পঙ্‌ক্তিই যথেষ্ট, ‘‘কিসি কো আপনে আমল কা হিসাব কেয়া দেতে/ সওয়াল সারে গলদ থে জওয়াব কেয়া দেতে’’।

ইউরিদিকে নামের মেয়েটির মতো মৃত্যুপুরী পার হয়ে জীবনের দিকে আসছি আমরা। অর্ফিয়াস যত ভাল বাঁশিই বাজাক না কেন, তার অনিয়ন্ত্রিত আবেগ যদি আমাদের বেরিয়ে আসার পথে অন্তরায় হয়, তা হলে আপাতত শিল্প-শিল্পীকে একটু দূরে রেখে বাঁচাটা নিশ্চিত করে নিতে হবে। করতে গিয়ে হয়তো কয়েক জন চলে যাবেন, তবু অনেকে তো থাকবেন। যে বাস কন্ডাক্টর কলেজের ছাত্রীকে নিরাপদে নামানোর জন্য গতিপ্রেমী ড্রাইভারকে মিথ্যা করে বলেন, ‘‘আস্তে লেডিজ়, কোলে বাচ্চা’’, তিনি জানেন জীবনের মূল্য। যে মহীয়সী মুখ থেকে মাস্ক না খুলে আট ঘণ্টা আয়ার কাজ করেন, তিনি আমার প্রণম্যা। এ বারও বইমেলা না হলে প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত সবাই ভাতে মরবেন, অনেকের রুজিরুটি বন্ধ হবে গঙ্গাসাগর মেলা না হলেও। তবু আপাতত স্থগিত রাখতে হবে সব। ছুটিতে থেকেও যাঁরা মাইনে পেয়েছেন ও পাচ্ছেন (আমি নিজেই তাঁদের এক জন), তাঁদের আয় থেকে অন্তত এক-দশমাংশ বৃহত্তর সমাজকে বাঁচানোর কাজে ব্যয় করতেই হবে এই সময়ে। প্রত্যেককে কিছুটা করে দায়িত্ব নিতে হবে। এক জন প্রোমোটার যদি নিজের রাজমিস্ত্রিদের দেখাশোনা করতে পারেন, আমরা কেন পারব না?

বিশ্বাস যখন একটা সমাজের ভিত্তি তৈরি করে, তখন ‘সব ভাল হবে’র স্তোকবাক্যের আড়ালে দুর্নীতি মাথাচাড়া দেয়। তাই সমাজের ভিত্তি হোক, প্রশ্ন। উই শ্যাল ওভারকাম তখনই সত্য যখন ‘আই’ সর্বশক্তিমান নয়। তার আগে পর্যন্ত, ‘‘বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus in Kolkata Death Covid 19 corona
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy